বড় হয়ে
আমি লেখক হতে চাইতাম। কিন্তু লেখক কিভাবে হবো আমার জানা ছিলো না। আব্বাকে জিজ্ঞাসা
করলাম- ‘লেখকরা কি লেখে?’ আব্বা বললেন- ‘লেখকরা বই লেখে।’ তখন থেকে আমার মনে হতে থাকলো আমাকেও বই লিখতে হবে, লেখক
হতে হবে। বড় হয় যেনো আমরা বিসিএস পরীক্ষা দেই সেজন্য আব্বা কিছু সাধারণ জ্ঞানের বই
এনে দিয়েছিলেন। বাসায় সেগুলো আমাকে পড়ে শোনাতেন। আমি সেই বই শুনে শুনে সিদ্ধান্ত
নিলাম আমাকে সাধারণ জ্ঞানের বই লিখতে হবে।
আমার
বয়স তখন ৬-৭ হবে, ক্লাস ২ এ পড়ি। সবকিছু এতো স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু যা মনে আছে, তাও
কম না। আমাদের স্কুলে ক্লাস ৩ পর্যন্ত মেয়েদের সাথে শিফট, মানে সকাল ৭ টা থেকে
দুপুর ১২ টা। একটা স্কুল ভ্যান আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতো, নিয়ে আসতো। দুপুরে এসে
আমি গোসল করতাম, খাবার খেয়ে ঘুমাতে যেতাম, বিকালে উঠে নিচে খেলতে যেতাম। বড়দের
খেলা যেমন- ফুটবল, ক্রিকেটে আমাদের দুধভাত খেলোয়ার হিসেবে নেয়া হতো, আমরা তাই
নিজেরা বরফপানি, সাতচারা এগুলো খেলতাম।
যেদিন
প্রথম বই লিখলাম সেদিন এই রুটিনের ব্যতিক্রম হয়েছিলো। আমি এসেই একটা খালি খাতা,
কাঁচি, আঠা, সাধারণ জ্ঞানের বই আর বেশ কিছুদিন ধরে জমানো স্টিকার নিয়ে বসে গেলাম। আমার
ছোট দুই ভাই আমাকে ঘিরে বসলো। খাতার উপরে বড় বড় করে লিখলাম- ‘সাধারণ জ্ঞান’, তারপর নিজের
পুরো নাম। তারপর এর আশপাশে কিছু ছোটো ছোটো স্টিকার লাগালাম- প্লেন, বাঘ, ডাইনোসর
ইত্যাদির, ব্যাস বইয়ের মলাট তৈরী।
এবার
ভেতরের লেখা তৈরীর পালা। ছোটো ভাইদের দায়িত্ব দিলাম সাধারণ জ্ঞানের বইগুলো থেকে
ছবিগুলো কেটে আলাদা করে দিতে। আমি সেগুলো
খাতার ভেতরে আঠা দিয়ে লাগাতে লাগলাম। বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টার- ডাইনোসর। ডাইনোসরের
কিছু স্টিকার ছিলো- অর্ধেক পৃষ্ঠা সাইজের। সেগুলোর নিচে লিখলাম- ডাইনোসর। পরের
চ্যাপ্টার- খেলাধুলা। সেখানে শচীন টেন্ডুলকারের ছবি লাগিয়ে নিচে নাম লিখে দিলাম। পশুপাখি
বলে একটা চ্যাপ্টার করা হলো, সেখানে বাঘ, হরিণ, ইলিশ মাছ, দোয়েল পাখি ইত্যাদির ছবি
বা স্টিকার লাগালাম।
সাধারণ
জ্ঞানের বইগুলো থেকে ছবি কেটে আনলেও তখন রেফারেন্সিং বিষয়টা জানতাম না বিধায়,
ফুটনোট দেয়া হয়নি। অন্তত তিনটা বই থেকে কাট-পেস্ট করা হলো। মৌলিক বলতে ছিলো শুধু
জমানো স্টিকারগুলো।
এখন
বুঝতে পারছি বইয়ের টাইটেল আসলে ‘সাধারণ জ্ঞান’ না হয়ে হওয়া উচিত ছিলো- ‘এনসাইক্লোপেডিয়া’। সংগ্রহে থাকা সব স্টিকার আর ছবি সন্ধ্যার মধ্যে লাগানো
হয়ে গেলো। এবার আব্বাকে বই দেখানোর পালা, আপনার ছেলে লেখক হয়ে গেছে।
বিকালে
আমরা বাসায় থাকলে সাধারণত খুব চিল্লাপাল্লা করতাম, বারান্দায় পানি ঢেলে নদী-নদী
খেলতাম, অথবা বালিশের উপরে চড়ে ঘোড়া-ঘোড়া খেলতাম। সেদিন কোনো চিল্লাপাল্লা নেই। আম্মা
বিকালে এসে একবার দেখে গেলেন আমরা তিন ভাই মনোযোগ দিয়ে বই কাটছি আর খাতায় সেগুলোকে
আঠা দিয়ে আটকাচ্ছি। আম্মা কিছু বললেন না।
সন্ধ্যায়
আব্বা আসলে আমরা বই দেখালাম। আব্বা দেখে খুব খুশি হলেন-
‘সাধারণ জ্ঞানের বই
লেখছো?’
‘জ্বি আব্বা...’
‘কয়টা বই নষ্ট
করছো?’
‘তিনটা আব্বা...’
‘আচ্ছা... আবার
নিয়া আসবো বই... এর পরের বই কি নিয়া লেখবা...’
‘ডাকটিকেট নিয়া...’
আব্বা
বুঝতে পারলেন তার দীর্ঘদিনের জমানো ডাকটিকিটের ডায়েরী এখন বিপন্ন অবস্থায় আছে। এরপরের
কিছুদিন আমরা আর ডাকটিকিটের ডায়েরীটা খুঁজে পেলাম না। অনেক বড় হওয়ার পর যখন
হাইস্কুলে গেলাম তখন আব্বার বুকশেলফের ভেতরে সেটাকে পেলাম। কিন্তু তখন আর ডাকটিকিট
নিয়ে বই লেখার আগ্রহ নেই।
‘সাধারণ জ্ঞান’ বইটি আমার লেখা একমাত্র এনসাইক্লোপেডিয়া, যেটার পাণ্ডুলিপি
কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment