বড় হয়ে
আমি রাষ্ট্রপতি হতে চাইতাম। তখন মার্ক্স-এঙ্গেলসের ছাত্র, শোষনমুক্ত সমাজের
স্বপ্নে বিভোর এক তরুন মাত্র। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হওয়া তো মুখের কথা না, রাষ্ট্রপতি
হতে গেলে একটা দেশ লাগে। আর দেশ হতে গেলে লাগে- জায়গাজমি, নাগরিক, সরকার,
সার্বভৌমত্ব আর আইন-কানুন। তখন বিকেল বেলা বাসা থেকে বের হয়ে চায়ের দোকানে বসি আর
বন্ধুরা মিলে মাঝরাত পর্যন্ত দেশ আর রাজনীতির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করি।
কবে বড়
হবো, কবে ক্ষমতা নিবো, তারমধ্যে এই রাজনৈতিক হাঙ্গামা, কে চায়? তারচেয়ে একটা দেশ
বানিয়ে ফেলা সহজ। দেশের আইডিয়াটা আমি সবচেয়ে নিকটস্থ বন্ধুকে বলেই ফেললাম। একটা
দেশ হতে গেলে কি কি লাগে বিস্তর আলাপ করলাম। বন্ধুও তাল দিলো- হ, হ। আমরা ৫ বন্ধু
তখন নিয়মিত আড্ডায় বসি। এদের মধ্যে একজন সাস্টের, আরেকজন জগন্নাথের ছাত্র। ওরা
সপ্তাহে দুয়েকদিন সময় দিতে পারতো। ওদের সাথেও আলাপ হলো। দেশ গঠনের কাজ শুরু হলো।
প্রথমেই
জায়গাজমি। বন্ধু মৃন্ময়ের বাসাকে ‘বঙ্গভূমি
প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা দেয়া হলো। আর ওর বাসার ছাদের
নামকরণ করা হলো- ‘হাসানাবাদ’, বঙ্গভূমি
প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। আমরা ৫ বন্ধু আর ১ ছোটোভাই হলাম রাষ্ট্রের প্রথমদিককার
নাগরিক। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আস্তে আস্তে এই রাষ্ট্রে আরো অনেককে নাগরিকত্ব দেয়া
হবে। নাগরিকত্ব আবেদনের জন্য ফরমের খসড়া রেডি করা হলো। দেশকে গতিশীল করার
উদ্দেশ্যে প্রথম ৬ জন মিলে গঠিত হলো অস্থায়ী সরকার।
৬ জনের
রাষ্ট্র হলেও পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘পার্লামেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করা হলো। মৃন্ময়ের রিডিং রুমের বড় গোল টেবিলটাকে
পার্লামেন্ট হিসেবে ঘোষনা করা হলো। রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং
পলিসি পার্লামেন্টের সম্মতি ছাড়া নেয়া যাবে না। পার্লামেন্টের অনুমতিক্রমে খসড়া
সংবিধান প্রণয়ন করা হলো। রাষ্ট্রপতি হবেন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। তাকে সাহায্য
করার জন্য থাকবে মন্ত্রীপরিষদ।
নির্বাহী
দায়িত্ব বণ্টন করার জন্য পার্লামেন্ট অধিবেশন ডাকা হলো। রুদ্ধশ্বাস সেই অধিবেশনে
গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট। ভোটাভুটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার উদ্দেশ্যে এবং
বন্ধুদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ এড়ানোর জন্য ছোটভাইকে করা হলো বঙ্গভূমি
প্রজাতন্ত্রের প্রধান নির্বাচন কমিশনার। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের
মাধ্যমে আমি হলাম প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি, মৃন্ময় প্রধানমন্ত্রী, সিঞ্চন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মামুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মিথুন অর্থমন্ত্রী আর ছোটোভাই নাইম
পার্লামেন্টের স্পিকার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং একই সাথে শিক্ষা এবং বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তি মন্ত্রী।
দায়িত্ব
বন্টনের পরে আসে জাতীয় পরিচয়ের প্রসঙ্গ। আলাদা রাষ্ট্র হতে গেলে সবকিছু আলাদা হওয়া
লাগে। আমরা রাষ্ট্রের জন্য একটি পতাকা পার্লামেন্টে পাশ করলাম। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটিকে করলাম জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় পাখি- মাছরাঙা, জাতীয়
ফল- আম, জাতীয় ফুল- বকুল ইত্যাদি।
রাষ্ট্রপতিশাসিত
প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েও আমি স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারিনি। রাষ্ট্রপতির
ইচ্ছাই রাষ্ট্রের আইন, এটা বঙ্গভূমি প্রজাতন্ত্রে ছিলো না। যেমন জাতীয় ফুলে আমার
ক্যান্ডিডেট ছিলো- শিউলি। কিন্তু পার্লামেন্টে বাকিদের ভোটে আমার ক্যান্ডিডেট হেরে
যায়। পার্লামেন্ট জাতীয় ফুল হিসেবে বকুলকে পাশ করে, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী
হিসেবে পার্লামেন্টের পবিত্র সিদ্ধান্ত আমাকে মেনে নিতে হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ট্যাক্স দিতে হয়। ট্যাক্স বিষয়ক পলিসি রেডি করার জন্য অর্থমন্ত্রী দিনরাত এক করে ফেলে। ট্যাক্স হয় সাধারণত ইনকামের উপর। কিন্তু আমরা সবাইতো ছাত্র। কেউ টিউশনি করে, কেউ বাসা থেকে হাতখরচের টাকা নিয়ে চলে। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো- ট্যাক্স নির্ধারিত হবে আমাদের মাসিক খরচের উপর।
পার্লামেন্টে
ব্যাপক আলাপ আর ভোটাভুটির পর বিল পাশ হলো- মাসিক মোট খরচের ৪% টাকা আমরা বঙ্গভূমি
প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিবো। মানে প্রতি ১০০০ টাকা খরচের সময় ৪০
টাকা রাষ্ট্রের জন্য আলাদা করে রাখতে হবে। যখন কামাই করবো, তখন ইনকাম ট্যাক্স বলবৎ
হবে বলে ধারা থাকলো। এখানেও আমার প্রস্তাব পার্লামেন্টে পাশ হয় নি। আমার প্রস্তাব
ছিলো ২.৫%। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো নিজেরা মুদ্রা না ছাপানো পর্যন্ত বাংলাদেশের
টাকাই প্রজাতন্ত্রের ডিফ্যাক্টো মুদ্রা হিসেবে থাকবে।
পার্লামেন্টে
খসড়া সংবিধান আর আইনকানুন পাশ হতে থাকলো। প্রত্যেক শুক্রবার পার্লামেন্টের নিয়মিত
অধিবেশন বসতো। ৬ মাস নিয়মিত ট্যাক্স কালেক্ট করা হলো। নতুন বেশ কয়েকজনকে নাগরিক
করার বিষয়ে আলাপ-আলোচনাও চললো। পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নিলো ট্যাক্সের টাকায়
নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল কাউকে নাগরিকত্ব
দিয়ে তাকে একটা রিক্সা কিনে দেয়া হবে অথবা চায়ের দোকান করে দেয়া হবে।
শিক্ষাব্যবস্থা
নিয়ে রাষ্ট্রের নিজস্ব পলিসি রেডি করা হচ্ছিলো। শিক্ষা হবে কমিউনিটি বেইজড,
একমুখী, বিজ্ঞানমুখী এবং কর্মমুখী। মানে কমিউনিটির সব বাচ্চাকে তাদের পিতামাতার
অর্থনৈতিক কন্ডিশনের উপর ভাগ না করে, সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে একই স্কুলে পড়ানো। আর
কমিউনিটি স্কুলের সব বাচ্চাদের দায়িত্ব আর খরচ নির্বাহ করবে কমিউনিটির সবাই।
কর্মমুখী শিক্ষাকে গুরুত্বের সাথে নেয়া হলো। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে বাচ্চাদের
এমন কোনো হাতের কাজ শেখানো হবে, যাতে তারা সাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। সিদ্ধান্ত নেয়া
হলো- নিজেদের বাচ্চাদের দিয়ে সেই স্কুল শুরু করা হবে।
নাগরিকদের
জন্য কিছু আলাদা নিয়ম ছিলো। যেমন-
১। ধর্ম, লিঙ্গ, গায়ের রঙ, আঞ্চলিকতা, রাষ্ট্রীয় পদ, অর্থনৈতিক অবস্থার উপরে নাগরিকদের সাথে বৈষম্য করা যাবে না।
২। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে সিদ্ধান্তই আসুক না কেন, সবাইকে তা মেনে নিতে হবে, যদিও তা নিজের মত বা প্রভাবশালী ব্যক্তির বিপক্ষে যায়।
৩। জায়গা মতো ময়লা ফেলা, যত্রতত্র থুথু না ফেলা, আরেকজনকে কথা বলতে দেয়া, ভিন্নমতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইত্যাদি আরো অনেক আচরণকে নাগরিক শিষ্টাচার হিসেবে পালন করা।৪। জাতীয় পতাকাকে সম্মান করা, জাতীয় সঙ্গীত চলাকালে দাঁড়ানো এবং অন্যান্য কাজ করা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদিও নাগরিক শিষ্টাচারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
কিন্তু
উত্থানের পরেই আসে পতন। যখন রাষ্ট্র খুব ভালো চলছে, তখনি হঠাৎ আমাদের আগ্রহে ভাটা
পরে যায়। কবে সবাইকে বোঝানো শেষ হবে, কবে সবাই শিক্ষিত হবে, কবে সবাই নাগরিক হবে! সর্বপ্রথম
অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব আর সামলাতে পারছিনা বলে পদত্যাগ করলো। পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি সংগঠনের অনুষ্ঠানের জন্য পার্লামেন্ট অধিবেশন মিস করলো। পরবর্তী
অধিবেশনে ভোটাভুটি করে রাষ্ট্রকে ডিজব্যান্ড করা হলো। এখন থেকে বঙ্গভূমি
প্রজাতন্ত্র নামে পৃথিবীর বুকে আর কোনো রাষ্ট্র থাকবে না।
৬
তরুনের শোষনমুক্ত, বৈষম্যহীন, স্বনির্ভর রাষ্ট্রপ্রকল্পের স্বপ্ন এখানেই শেষ হলো।
No comments:
Post a Comment