25 February 2021

তুরস্কের ইতিহাস ও রাজনীতি। পর্ব ২। আনাতোলিয়ার প্রাচীনকাল

 

পৃথিবীর ইতিহাসে আনাতোলিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। প্রাচীনকালে আনাতোলিয়া এশিয়া মাইনর নামেও পরিচিত ছিলো। সুপ্রাচীনকাল থেকেই আনাতোলিয়াতে মানববসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। সবচেয়ে প্রাচীন মানবসভ্যতা সুমেরিয় সভ্যতার একদম কাছাকাছি অবস্থান ছিলো আনাতোলিয়া। এছাড়া আনাতোলিয়া ভূরাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এশিয়া এবং ইউরোপের সংযোগস্থল হিসেবে আনাতোলিয়া সবসময়েই ক্ষমতার ইতিহাসের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো।

গবেষকরা ধারণা করেন আনাতোলিয়ায় অবস্থিত গাতালহুইয়ুক পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শহর। শহরের গড়ে উঠার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৭৫০০ থেকে ৭০০০ সাল। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৯০০০ বছর আগেই আনাতোলিয়ার জনগোষ্ঠী সভ্যতার ছোঁয়া পায়। মধ্য আনাতোলিয়ায় গড়ে উঠা সভ্যতার বাকী প্রাচীন শহরগুলো হচ্ছে- গায়ুনো, আসিকলি হুইয়ুক, গোবেকলি তেপে, মেরসিন, নেভালি চোরি, হাচিলার ইত্যাদি।

প্রথমে নগররাজ্য গড়ে উঠলেও খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ২২০০ সালের মধ্যে হাত্তুশ শহরকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হতে থাকে। আনাতোলিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী হাত্তিন সাম্রাজ্য সবচেয়ে প্রাচীন, কিন্তু এর খুব কম ঐতিহাসিক দলিলই পাওয়া যায়। হাত্তিন সাম্রাজ্য সম্পর্কে তার প্রতিবেশী ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। পরবর্তী হিট্টাইট ও আক্কাদিয় সাম্রাজ্যের বর্ননায়ও হাত্তিন সাম্রাজ্যের প্রসঙ্গ আসে। হাত্তিন সাম্রাজ্য বেশিদিন টিকে থাকেনি। এর জায়গায় ক্ষমতার আসে হিট্টাইট সাম্রাজ্য

খ্রিস্টপূর্ব ১৪ শতকে মধ্যপ্রাচ্য ও আনাতোলিয়া 

হিট্টাইট সাম্রাজ্য আনাতোলিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৮০ খ্রিস্টপুর্বাব্দে। আনাতোলিয়া জুড়ে হিট্টাইট আমলের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রতিবেশি আক্কদিয় সাম্রাজ্য এবং মিসরিয় সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধ এবং চুক্তির প্রমানও পাওয়া গেছে। মিসরিয়রা হিট্টাইটদের কাছ থেকে ঘোড়ায় টানা রথ চালনা শেখে। বাইবেলেও হিট্টাইট সাম্রাজ্যের কথা এসেছে। হিট্টাইটদের সাথে পাশের রাজ্য ফিনিশিয়া এবং ক্রিট দ্বীপের নিয়মিত বাণিজ্যের বিবরণও পাওয়া গেছে। হিট্টাইট সাম্রাজ্যের পতন হয় ১১৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পতনের পর হিট্টাইট সাম্রাজ্য সিরো-হিট্টাইট বিভিন্ন ছোটো ছোটো রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়।

হিট্টাইটরা যখন সাম্রাজ্য বিস্তার করছে প্রতিবেশীরা গ্রীকরা তখনো নগররাষ্ট্র গড়ে তুলছে। গ্রীকরা তখন আইওনিয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে ধীরে পূর্বে কলোনি বিস্তার করছে। আনাতোলিয়ার ভূমধ্যসাগর উপকূলে গ্রীকরা বেশ কিছু নগররাষ্ট্র গড়ে তোলে। আনাতোলিয়ার গ্রীক নগররাষ্ট্রগুলো ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে। হিট্টাইটদের পতনের পর পশ্চিম ও মধ্য আনাতোলিয়ায় বেশ কিছু গ্রীক নগররাষ্ট্র কেন্দ্রীক জোট ও রাজ্য গঠিত হয়।

পশ্চিম ও মধ্য আনাতোলিয়ার গ্রীক রাজ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ট্রয়, আয়োলিস, লিডিয়া, লিসিয়া, মাইসিয়া, কারিয়া, আয়োনিয়া এবং ফ্রিজিয়া। পূর্ব আনাতোলিয়ার কিছু অংশ দখল করে নেয় প্রতিবেশী আসিরিয় সাম্রাজ্য। এছাড়া আরো দুইটি রাজ্য গড়ে উঠে পূর্ব আনাতোলিয়ায়- সিমেরিয়া ও উরারতু।

আসিরিয় সাম্রাজ্যের যুগে আনাতোলিয়া ৮২৪-৬৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ 

প্রাচীন আনাতোলিয়া তিনটি সভ্যতার মাঝখানে ছিলো। পশ্চিমপাশে গ্রীক সভ্যতা, দক্ষিন-পূর্ব পাশে সুমেরিয় সভ্যতা এবং দক্ষিন-পশ্চিম পাশে মিসরিয় সভ্যতা। এই তিন সভ্যতা থেকেই আনাতোলিয়া উপকৃত হতে থাকে। আবার সভ্যতাগুলোর সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় সবসময়েই ত্রিমুখী আক্রমন এবং ক্ষমতার পালাবদলের ভয়ে ভীত থাকতে হতো।

গ্রীকরাজ্যগুলোর মধ্যে আনাতোলিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে- লিডিয়া। লিডিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আর পতন হয় ৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পতনের আগে লিডিয়া পুরো পশ্চিম ও মধ্য আনাতোলিয়া জুড়ে প্রভাববিস্তার করে। লিডিয়ার প্রতিবেশী ছিলো মধ্য ও পূর্ব আনাতোলিয়ার মেডিয়া রাজ্য ও সাইলেসিয়া রাজ্য।

৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পার্শ্ববর্তী আকামেনিয় সাম্রাজ্যের (পারস্য- বর্তমানে ইরান) সম্রাট সাইরাস দ্যা গ্রেট লিডিয়া দখল করে নেন এবং সাম্রাজ্যের প্রদেশ বানান। মেসিদনের রাজা ফিলিপের ছেলে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট পারস্য দখলে নেয়ার আগপর্যন্ত লিডিয়া এবং সমস্ত আনাতোলিয়া আকামেনিয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকে। ৩৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট আনাতোলিয়ার পথে পারস্য আক্রমন করেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন শাসন করতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য সেনাপতিদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়।

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সেনাপতিদের মধ্যে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। প্রায় ৪০ বছর ধরে চলে এই যুদ্ধ (ডায়াডোখি- উত্তরাধিকারের যুদ্ধ)। আনাতোলিয়া অঞ্চলের ছোটো ছোটো রাজ্য সেনাপতিদের দখলে চলে যায়। গুপ্তহত্যা, ক্ষমতার পালাবদল ও আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার রাজনীতি শুরু হয়। ডায়াডোখি যুগে আনাতোলিয়া অঞ্চলের ক্ষমতাসীন সেনাপতিদের তালিকা হলো-

রাজ্য

সেনাপতি

হেলেসপন্টিন ফ্রিজিয়া

লিওননাটুস

লিডিয়া

মিনান্দার

কারিয়া

আসান্দার

ফ্রিজিয়া, লিসিয়া, পাম্ফিলিয়া

এন্টিগোনাস

কাপাডোশিয়া, পাফ্লাগোনিয়া

ইউমেনেস

সাইলেসিয়া

ফিলোটাস

আর্মেনিয়া

নিওটলেমাস

মাঝখানে কিছু বছরের জন্য আনাতোলিয়ায় এন্টিগোনাস শক্তিশালী হয়ে উঠেন। কিন্তু পারস্যের সেলুকাস, মিসরের টলেমি এবং থ্রেসের লাইসিমাকোসের চাপে থাকে থাকতে হয়। শেষ পর্যন্ত পারস্যের সেলুসিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয় আনাতোলিয়া। কিছু বছর পরেই আবার ছোটো ছোটো রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়। সেলুসিড সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হওয়া, আবার দখল হওয়া, আবার বিদ্রোহ করে স্বাধীন হওয়া এর মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলো আনাতোলিয়ার ইতিহাস।

ডায়াডোখি- উত্তরাধিকারের যুদ্ধ, এন্টিগোনাসের আনাতোলিয়া
আনাতোলিয়ার উত্তরে কৃষ্ণসাগরের উপকূলের এরকম একটি ছোটো রাজ্য পন্টাস গড়ে উঠে ২৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আনাতোলিয়ার ক্ষমতা যখন পন্টাসের রাজাদের হাতে যায় তখন ৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ততোদিনে রোমানরাও সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগ দিয়েছে। খ্রিস্টপুর্ব ৩১ থেকে শুরু করে ৬ পর্যন্ত ধীরে ধীরে পুরো আনাতোলিয়া রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়।

সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যে ভাঙন ধরে ২৭১ খ্রিস্টাব্দে। আনাতোলিয়া পরে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের ভাগে। কিছুদিন পর রোমান সাম্রাজ্য আবার একীভূত হয়, আবার ভাঙন ধরে। ৩০৬ সালে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় আসেন সম্রাট কন্সট্যান্টিন দ্যা গ্রেট। ক্ষমতায় আসলেও সিংহাসন নিরঙ্কুশ করতে করতে ৩২৪ সাল হয় সম্রাট কন্সট্যান্টিনের। তার নতুন রোমান সাম্রাজ্যের জন্য একটি আলাদা রাজধানীর প্রয়োজন দেখা দেয়। এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে, মার্মারা সাগরের উপকূলে প্রাচীন গ্রীক নগর- বাইজেন্টিয়াম, এর উপরে তখনকার আধুনিক রোমান স্থাপত্যকলা প্রয়োগ করে ৩৩০ সালে গড়ে তোলা হয়, কন্সট্যান্টিনোপোল নগরী। কন্সট্যান্টিনোপোল নগরীই আজকের ইস্তানবুল।

সম্রাট কন্সট্যান্টিন দ্যা গ্রেট ইতিহাসে প্রসিদ্ধ ১ম খ্রিস্টিয়ান সম্রাট হিসেবে। তিনি খ্রিস্টিয়ান ধর্মকে রাজধর্ম ঘোষণা করেন। খ্রিস্টিয়ানদের বিখ্যাত কাউন্সিল অব নিকেয়া তার রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনে অবস্থিত খ্রিস্টিয়ানদের পুরাকীর্তি তিনি সংস্কার করান। অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ানরা সম্রাটকে এখনো সম্মান করে থাকে।

আনাতোলিয়া এই সময়ে পুরোপুরি গ্রীক অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে পতনের আগ পর্যন্ত এই গ্রীক সংস্কৃতি বজায় থাকে। সম্রাট কন্সট্যান্টিনের বংশধররা ৩৬৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য শাসন করেন। এর পরে বিভিন্ন গ্রীক রাজবংশ আনাতোলিয়া শাসন করে থাকেন। ৩২৪ থেকে ১৪৫৩ সালে অটোমানদের হাতে কন্সট্যান্টিনোপোল নগরীর পতন পর্যন্ত সময়কালকে বলে হয় বাইজেন্টাইন শাসনামল।

No comments:

Post a Comment