27 September 2020

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রঃ মূল্যবোধের আলাপ


পারিবারিক মূল্যবোধের কথা বলি। পারিবারিক মূল্যবোধ আসবে কোত্থেকে? পরিবার নিজেই তো মূল্যবোধ শিখে আসে নি। পরিবার আসলে শেখায় ৩ বেলা খাওয়া, ১ বেলা ঘুম, পড়াশোনা শেখার নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করা, ক্লাসে ১ম হতে হবে বিষয়ক নির্যাতন ইত্যাদি। পরিবারের ধারণা ক্লাসে ১ম হলে, ভালো চাকরি হবে, ভালো চাকরি হলে ছেলে আগামী জীবন ভালোভাবে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারবে। খেয়েপরে বেঁচে থাকার টেকনিক শেখাই আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ।

অনেকে পরিবারের দোষ দিতে চায় না, বলে মাত্র ৩ জেনারেশন আগে আমরা কৃষক ছিলাম, অনেক যুদ্ধ-দাঙ্গা-ক্ষরা-দুর্ভিক্ষ থেকে আমাদের প্রবৃত্তি খাওয়াপরার সংগ্রামকেই জীবনের মূল্যবোধ হিসেবে আত্মস্থ করে নিয়েছে। ৩ জেনারেশন আগে কেবল আমরাই কৃষক ছিলাম না, পৃথিবীর বেশিরভাগ জাতিই কৃষক ছিলো। চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ানরাও ৩ জেনারেশন আগে কৃষক ছিলো। তারা কিভাবে পারিবারিক মূল্যবোধ শিখে গেলো!

যুদ্ধ-দাঙ্গা-ক্ষরা-দুর্ভিক্ষ এর ভেতর দিয়ে যায়নি, এমন জাতি একটাও নেই পৃথিবীতে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা আমাদের চে আরো বেশি গিয়েছে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের আগে আগে জাপান যখন কোরিয়া আর চীন দখল করে নিচ্ছিলো তখন জাপানে তাদের ব্যাপারে প্রবাদের মতো কিছু কথা প্রচলিত ছিলো- কোরিয়ানরা অলস আর চাইনিজরা মাথামোটা। অলস কোরিয়ান, মাথামোটা চাইনিজ আর দখলদার জাপানিজরা এখন কে কেমন আছে?

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র, মানুষের জীবনের ৩ গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। মূল্যবোধের বিচারে এই তিনটার কার্যক্রমে খুব বেশি পার্থক্য নেই। পরিবার যাকে লোকমা দিয়ে খাওয়ায়, সমাজ তাকে ছায়া দিয়ে রাখে, রাষ্ট্রে সেই ধনে-মানে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মানুষ আসলে অপরাধপ্রবণ প্রাণী। সুযোগ পেলেই অপরাধ করবে। কিন্তু খুন ও ধর্ষণ এমন অপরাধ যাকে কোনোভাবেই জাস্টিফাই করা যায় না। কেবলমাত্র নিজের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষা করা ছাড়া খুন করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। মানুষ খুন করার চেয়ে বড় কোনো অপরাধ নেই। খুন তো তাও বলা যায় নিজেকে রক্ষার জন্য করা গেছে, ধর্ষনকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

ধর্ষন মানে আরেকজনকে ছোট করা, হেয় করা। তা সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, সুস্থ হোক বা প্রতিবন্ধী হোক, বাচ্চা হোক বা বয়স্ক হোক। জোরজবরদস্তিমূলক পেশীতন্ত্রের প্রকট আলামত- ধর্ষন।

যে ধর্ষন করে সে বছরের ৩৬৫ দিন, দিনের ২৪ ঘণ্টা ধর্ষন করে বেড়ায় না। কিন্তু এটা এমন অপরাধ যাকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। একবার করে ফেললেই হয়ে গেলো। সারাবছর পেশীতন্ত্রের ভার বয়ে বেরানো মানুষটাই দিনশেষে ধর্ষক হয়ে উঠে। মানুষের সমাজ থেকে পুরোপুরি ধর্ষন বিলুপ্ত করা হয়ত সম্ভব না, কিন্তু তার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব।

যদি পরিবার যথাযথভাবে তার বাচ্চাকে যৌন শিক্ষা দেয়, তাকে শেখায় যে যৌনকর্ম জোর করে করার বিষয় না। যৌনকর্ম একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ, যেটা আরেকজনের সম্মতিতে করতে হয়। এমনকি প্রত্যেকবার যৌনকর্মের আগে সম্মতি নেয়া প্রয়োজন। একবার সম্মত হলেই যে অপরজন পরেরবার সম্মত হবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। এছাড়া যৌনকর্ম মানবজাতির সদস্য বৃদ্ধির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। তুমিও এভাবে এসেছো, আমিও এভাবে এসেছি।

পরিবার থেকে বাচ্চাকে নিজের প্রাইভেট পার্টস শেখানো। তাকে শেখানো, এগুলো তোমার এমন নিজস্ব অংগ, যেগুলো এমনকি বাবা-দাদারো ধরার অধিকার নেই।

মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শেখানো। নারী বা পুরুষ, সাদা বা কালো, প্রতিবন্ধী বা দুর্বল, বাঙ্গালী বা আদিবাসি, মুসলমান বা হিন্দু হিসেবে নয়। সকল মানুষই মানুষ, কেউ আপনার চেয়ে ছোট বা বড় নয়। আরেকজনকে একটু অন্যরকম দেখা যায় তাই সে আমার চেয়ে নিচে বা উপরে, কেউ আপনার ধর্ম পালন করে না তাই সে আপনার চেয়ে নিচে, কেউ কিছু টাকাপয়সা করে ফেলেছে বা রাজনীতি করে বলে আপনার চেয়ে উপরে, এমনটা নয়। সবার আগে পরিবার থেকে শেখান, সকল মানুষ সমান। সকল মানুষ সমান...

সমাজের দায়িত্ব ধর্ষককে সামাজিকভাবে বয়কট করা। কিছু লোক থাকে যারা ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গায়, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে ও এই ধর্ষনটা করতে বাধ্য হয়েছে টাইপ বক্তব্য দেয়। কেউ আবার বলার চেষ্টা করে, ভিকটিমেরই দোষ ছিলো, ও কম জামাকাপড় পরে ধর্ষককে উস্কানি দিয়েছে। চোখের সামনে গিয়ে পেটিকোট মেলে দিলে কার মাথা ঠিক থাকে বলেন?! আপনার সামনে মেলে দিলে আপনি করতেন না ধর্ষন!

এদের চিনে রাখুন, ধর্ষক ও ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গাওয়া দুইজনেই সমান অপরাধী। ধর্ষককে বিচারের মুখোমুখি করুন আর সাফাই গাওয়া লোকগুলোকে ৩ বেলা থাবরান। ৩ বেলা বন-চটকানা খেলে ধর্ষনের পক্ষে সাফাই গাওয়া লোকগুলো হয়ত পরেরবার সাফাই গাওয়ার আগে মৌন থাকবে। এমনকি যদি যেকোনো দেশের রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী বা জাতিসংঘের মহাসচিবও ধর্ষনের পক্ষে সাফাই গাইতে আসে, তাকেও ৩ বেলা থাবরানো যেতে পারে।

আর বাদ থাকে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। রাষ্ট্রের উপর প্রবল চাপ তৈরী করতে হবে যেন ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। বিচার এমন হবে না যেন কোনো নির্দোষ দোষী হয় বা ব্যাক্তিগত শত্রুতার জেরে কেউ ধর্ষকের তকমা পায়। আবার বিচার মানে এমন না, যে মনে হলো আর ক্রসফায়ারে দিয়ে দিলাম। বিচার ছাড়া রাষ্টীয় হত্যাকাণ্ড অপরাধকে আরো বাড়িয়ে দেয়। রাষ্ট্রকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যেতে হবে যেন সে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সঠিক অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। অপরাধীর যে কোনো পরিচয়ের উপরে রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে যেন অপরাধী তার সাজা পায়। একজন অপরাধীও যদি আইন ও বিচারের ফাক গলে বের হয়, বাকী যারা আছে তারা অপরাধ করতে উৎসাহী হয়।

এখন ২০২০, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। এখানে নিজে ছাত্রলীগ করলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, মামা যুবলীগ করলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, বাপ স্বেচ্ছাসেবক লীগ করলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, রাজনীতি করা লাগে না সামান্য সুসম্পর্ক থাকলেও অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়। পকেটে টাকা থাকলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি হলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়। অপরাধ করে বিচারের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য এখানে আছে ১০১ টি কায়দা।

এর দায় কার? এর দায় আমাদের।

আমাদের বাচ্চারা বিকালে মাদ্রাসা থেকে এসে বলবে- বাবা... আল্লার ভয় দেখিয়ে হুজুর কি জানি করেছে, ওখান দিয়ে রক্ত পরছে। সেটাতে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন পিতা। যাক হুজুর বলাৎকার করার পর মাদ্রাসার গ্রিলে ঝুলিয়ে দেয় নি বাচ্চাকে, যে ৮ বছরের বাচ্চা সুইসাইড করেছে। ৮ বছরের বাচ্চা না বোঝে বলাৎকার, না বোঝে সুইসাইড।

অথবা আমাদের বাচ্চারা আর স্কুল থেকে আসছেনা দেখে রাত ১১ টায় বের হয়ে দেখতে পাবো, বাসা থেকে ১ মাইল দুরে রাস্তার পাশে ঝোপে পরে আছে প্রিয়জনের রক্তাক্ত শরীর। ধর্ষনের পরে খুন। ধর্ষন যে করেছে তাকে আমি চিনবো। কিন্তু গণ্যমান্যরা এসে বলবে- বিষয়টা সেটেল করে ফেলো, ২০ হাজার টাকা দিবো। তাছাড়া ঘরে আরেকটা মেয়ে আছে, তার কথাওতো বিবেচনায় রাখতে হবে।

আমার মেয়ের বা বোনের ধর্ষনকারীরা চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে, দোকানে বসে চা খাবে, ভোটের সময় ভোট চাইতে আসবে। মিছিলের সামনে দেখা যাবে তাদের। পুলিশের কাছে নালিশ দিতে গেলে বলবে নালিশ নেয়া যাবে না, ধর্ষকরা অনেক বিচিঅলা লোক, বোঝেনিতো বিষয়টা। তারচেয়ে একটা দারোয়ানের চাকরি নেন, আমাদের ভারমুক্ত করেন।

স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো। আমার হাত মুখ বেঁধে রেখে ৫-৭ জন নেশাখোর বন্ধু মিলে ধর্ষন করবে আমার স্ত্রীকে। মজার দৃশ্য- ধর্ষন। বন্ধুরা মিলে একটু মজা করলে কি কোনো দোষ হয়, বলেন! আপনারাই বলেন।

এমন একটা বাংলাদেশ পেয়ে গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়।

13 September 2020

ইরান-তুরস্ককে ঠেকাতে ইসরাইল-আরব জোট

 
 
সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি অন্যতম দখলদার শক্তি হিসেবে দেখে থাকে। গত ৭২ বছর ধরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে শান্তিকামী সকল মুসলমান ইসরাইল থেকে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি সেই দুরত্ব কমিয়ে আনছে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র।
 
জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনের অধিকৃত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল। আরব এবং মুসলমান রাষ্ট্রগুলো এই অন্যায় জবরদস্তিমূলক জমি অধিগ্রহণ মেনে নিতে পারে নি। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের সাথে মোট ৪ বার আরব রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধ হয়। কিন্তু দুর্বল সমরনীতি, কূটনীতি ও গোয়েন্দাদের ব্যররথতায় প্রত্যেকটি যুদ্ধেই আরব রাষ্ট্রগুলো পরাজিত হয়। ইসরাইলকে অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও যাবতীয় রকম সাহায্য করে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা শক্তি।
 
ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং ফিলিস্তিনিদের নিজের ভূমি থেকে সরিয়ে শরনার্থী বানাতে সমস্ত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রথম মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৪৯ সালে। কিন্তু ২০০৮ সালে ইসরাইলের গাজা আক্রমনের পর তুরস্ক-ইসরাইলের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। ২০০৮-৯ সালে ইসরাইল গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তুরস্ক একটি ত্রাণবাহী জাহাজ গাজায় পাঠাতে চাইলে ইসরাইল তাতে বাঁধা দেয়। ইসরাইল গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছাতে না দিয়ে বরং জাহাজে আক্রমণ করে। সেই আক্রমনে ৯ জন তুর্কি নাগরিক নিহত হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এরপর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে ইসরাইলকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এবং ইসরাইলের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক সীমিত করে নিয়ে আসেন।
 
ইসরাইলের সাথে ২য় মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে সম্পর্ক ছিলো ইরানের। পাহলভী রাজতন্ত্রের অধীনে ইরান আর ইসরাইলের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। এই সম্পর্কের অনুঘটক ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেনি সরকার ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে।
 
এরপর ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করে মিসর ১৯৭৮ সালে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। শান্তিচুক্তির উদ্যোক্তা ছিলেন নান আদার দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। সাদাত ও বেগিন শান্তিচুক্তির জন্য শান্তিতে নোবেলও পান ১৯৭৮ সালে। শান্তিচুক্তি হলেও সাদাতকে রক্ত দিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে এর মূল্য। ১৯৮১ তে এক অভ্যুত্থানে নিহত হন আনোয়ার সাদাত। মিসরের জনগণ আজও ইসরাইলকে শত্রুরাষ্ট্র গণ্য করে। ২০০৬ সালের এক জরিপে দেখা যায় ৯২% মিসরীয় ইসরাইলকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে।
 
ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে হলে জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে হয়। হয় রাজতন্ত্র নাহয় স্বৈরাচারী সরকারই কেবল পারে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে। যুক্তরাষ্ট্র তাই মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের আধিকার আদায়ের বিরুদ্ধবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসি সরকারের সময় ইসরাইলের সাথে মিসরের ঘনিষ্ঠতা কমে আসে। কিন্তু মুরসিকে হঠিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী প্রেসিডেন্ট সিসি আবার ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। সিসিকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সাহায্য লাগবেই।
 
এরপর মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে জর্দান ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করে ১৯৯৪ সালে। শান্তিচুক্তি করলেও জর্দান-ইসরাইল সম্পর্ক সুখকর হয় নি। ইসরাইল কর্তৃক বিতাড়িত ফিলিস্তিনি শর্নার্থী ও তাদের বংশধররা জর্দানের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। ফিলিস্তিনি শরনার্থীদের প্রবল চাপে বিধ্বস্ত জর্দান তাই ইসরাইল থেকে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখে।
 
মধ্যপ্রাচ্যের ঘোলাটে রাজনীতিকে আরো উস্কে দিয়ে সুবিধা বের করে আনতে পারদর্শী যুক্তরাষ্ট্র, সুযোগ কাজে লাগাতে ওস্তাদ। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার প্রায় ১০০ বছরের সাম্রাজ্যবাদী ইন্সটিংক্ট এবং মধ্যপ্রাচ্যের গণবিরোধী রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র। ২০১১ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর জনতা দীর্ঘ শোষন-দুর্নীতি ও রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। শুরু হয় জনতার স্বতঃস্ফুর্ত জাগরণ- আরব বসন্ত। আর অপরদিকে আরব বসন্ত থেকে সুবিধা বাগিয়ে নিতে উৎসুক যুক্তরাষ্ট্র সহ সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তি।
 
আরব বসন্তের ঢেউ একেক রাষ্ট্রে একেকভাবে লাগে। ব্যাপক আন্দোলনে একে একে পতন হয় স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টদের। তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবেদীন বেন আলী, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হয়। ব্যাপক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজতন্ত্রগুলো তখনকার মতো পরিস্থিতি সামাল দেয়। সৌদি আরব, বাহরাইন, জর্দান, ওমান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজতন্ত্রের ভিত কাপিয়ে দেয় আরব বসন্ত। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধে শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদীদের মজার খেলা- প্রক্সি ওয়ার; মাটি আপনার, যুদ্ধ আমার।
 
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কোনোক্রমেই ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না হওয়ায়, বিরোধী পক্ষরা সশস্ত্র পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ট ইসরাইল, সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিরোধীদের সবরকম সাহায্য দিতে থাকে। বাশার আল আসাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে- রাশিয়া ও ইরান। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ হয়ে যায় সৌদি আরব বনাম ইরানের লড়াই, যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়ার প্রেস্টিজ।
 
গৃহযুদ্ধ চলাকালীন দেশগুলোতে অর্থাৎ সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে; সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও বাহরাইন যে পরিমান মেধা-অর্থ ব্যয় করেছে তার কিয়দাংশ নিজের দেশের জনগণের জন্য ব্যয় করলে সেসব দেশের রাজতন্ত্রে অতিষ্ট জনগণ আরো একটু সুখী হতে পারতো।
 
ইয়েমেনের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সেখানে গৃহযুদ্ধের পাশাপাশি চলছে দুর্ভিক্ষ। অপুষ্টিতে ভোগা ইয়েমেনি শিশুরা ঘাস আর মাটি খেয়ে থাকছে। আর নিরস্ত্র ইয়েমেনিদের উপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণ চলছে। বোমাবর্ষণ চলছে মসজিদে, বাজারে, হাসপাতালে এবং বেসামরিক এলাকায়। এন্ড অল ক্রেডিট গৌস টু, গেস হু...! দ্যা ওয়ান এন্ড ওনলি সৌদি আরব। ইয়েমেনে সৌদি আরবের সহযোগী সংযুক্ত আরব আমিরাত আর মুখোমুখি ইয়েমেনের যুদ্ধবিদ্ধস্ত জনগণ আর ইরান।
 
যে সৌদি আরব, মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের খাদেম, সারা পৃথিবীর মুসলমানের ভরসা এবং নির্ভরতার জায়গা; সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা করতে গিয়ে, রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তার বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। একই সাথে বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে, ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন।
 
গত ১৩ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ১১ সেপ্টেম্বর বাহরাইন, ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করে। সৌদি আরবও ইসরাইলের সাথে ক্রমেই দুরত্ব কমিয়ে আনছে। আশা করা যায় মুহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ থাকতে থাকতেই সৌদি আরব ও ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যাবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের হঠকারী এই সিদ্ধান্তকে আবার স্বাগত জানিয়েছে আরেক স্বৈরাচার মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি।
 
সিরিয়া-ইয়েমেন-লিবিয়া ফ্রন্টে ইরান ও তুরস্ককে ঠেকাতে না পেরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন প্রভৃতি রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারি সরকার ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ইসরাইলের সাথে আরব এসকল রাষ্ট্রের যে কোনো রকম সম্পর্ক একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্নকে আরো দীর্ঘায়িত করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদকে শক্তি জোগাবে।

24 August 2020

আমার বন্ধু মেরাজ

আমার বন্ধু মেরাজ, যারা তাকে চিনেন, তারা ত চিনেনই। আর যারা চিনেন না, তাদের জন্য আজকের দুটি কথা।

মেরাজ আমার স্কুলের বন্ধু, এলাকার বন্ধু, বাল্যবন্ধু (আমাদের এলাকায় এটাকে বলা হতো, ন্যাংটাকালের বন্ধু, যদিও আমরা ততোটা ন্যাংটাকালের বন্ধু না।) যার সাথে আমার প্রচুর স্মৃতি। যারা আমাকে চিনেন তারা জানেন ছোটবেলা থেকে আমি অত্যন্ত শান্ত, আজ আমি যা কিছু চঞ্চল তা এই মেরাজের জন্য। এমনকি আমার ফেসবুক একাউন্টের জন্য তোলা প্রথম প্রোফাইল পিকচারটাও মেরাজের বাসার ছাদে ওর ফোনের ক্যামেরায় তোলা। যাই হোক, ঘটনায় যাই...

তখন আমরা ক্লাস টেনে, অনেক বড় হয়ে গেছি। কিন্তু বড় হয়ে গেছি এটা বোঝানোর উপায় কি? আমরা বড় হয়েছি এটা বোঝানোর জন্য আমাদের কিছু করতে হবে। তখন রোজার মাস, হালকা শীত, রাতে মসজিদে তারাবীর নামাজ চলে। এরকম সময়ে মেরাজ বাসার নিচে এসে ডাক দিলো। আমি নিচে নেমে দেখি মেরাজ লুঙ্গি পড়ে এসেছে। মেরাজ সাধারণত লুঙ্গি পরে রাস্তার এইপাড় আসে না। রাস্তার এইপাড় মানে তখনো গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার হয়নি। এখন ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ি অংশ যে জায়গায় নেমেছে তার নাম কাজলা। কাজলার হাইওয়ের এপাশে আমার বাসা, ওপাশে মেরাজের বাসা। এই হাইওয়ের দুইপাশেই আমাদের কৈশোর সময়ের একটা বড় অংশ কেটেছে।

মেরাজ লুঙ্গি পরে আসায় আমি একটু অবাক হলাম। 'কি রে লুঙ্গি পইরা আয়া পরলি!' মেরাজ বললো- 'হ... বাইত্তে তারাবি পরমু কইয়া বাইরাইছি...' তারপর আমরা শনির আখড়ার রাস্তার দিকে হাটতে থাকলাম। শনির আখড়া থেকে ভেতরে আরেকটা রাস্তা গেছে গোবিন্দপুরের দিকে। সেই রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ, বর্ষায় হাটু পর্যন্ত কাদা, শীতে-গরমে হাটু পর্যন্ত ধুলা। স্থানীয় এম্পির বিশেষ সুনজর পড়ায় ঐ এলাকার তখন এই অবস্থা, এলাকার লোকজনও তেমন গা করে না, তারা এভাবেই অভ্যস্ত। আমরা এমনভাবে হাটছি যেনো এই এলাকায় আমরা নতুন এসেছি। বেশ কয়েকজন ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখছেও। আমরাও ডানে-বামে সন্দেহজনকভাবে তাকাতে তাকাতে গোবিন্দপুরের রাস্তায় হাটছি।

কিছুক্ষন হাটার পর রাস্তা কিছুটা নির্জন হয়ে এলো। লোকজনের আনাগোনা কিছুটা কম, রাস্তায় আলোও কম। মেরাজ একটা দোকানের সামনে দাড়ালো। আমি একটু দূরে দাড়িয়ে ডানে বামে খেয়াল করছি। মেরাজ সেই দোকান থেকে দুইটা ক্যাসেল সিগারেট, একটা ম্যাচ কিনলো। আমরা অন্ধকার গলিতে ঢুকে গেলাম।

তখন ক্যাসেল সিগারেট পাওয়া যেতো, ২ টাকা দাম। গোল্ডলিফ ও ২ টাকা ছিলো, বেন্সন ছিলো ৩ টাকা। প্রথম কয়েকটা ম্যাচের কাঠি নষ্ট হলো। কিভাবে সিগারেটে আগুন ধরাতে হয় দেখেছি, কিন্তু শিখিনি। সিগারেট ধরানোর সাথে সাথে কাশি হলো, মাথা কেমন কেমন ঘুরলো। বেশ কয়েকটান দেয়ার পরই সিগারেট ফেলে দিয়ে অন্ধকার গলি থেকে বের হয়ে হলাম। বের হলাম আরো তাড়াহুড়ো করে দ্রুত পায়ে। কে যেনো গলির ভেতর আসছিলো। সে যদি জিজ্ঞাসা করে, কিরে পোলাপান কি করস!

গলি থেকে বের হয়ে খেয়াল পরলো সিগারেট খাওয়ার পর কেমন যেনো গন্ধ আসছে। আমরা দুইটা চুইংগাম কিনলাম। সেটা কিছুক্ষন চাবিয়ে দেখলাম গন্ধ যায় কিনা। তারপর হাতে-মুখে পানি দিলাম, চা-পানি এসব খেলাম। তবু মনে হচ্ছিলো গন্ধ যাচ্ছে না। বাসায় ধরা পরলে ত কড়া পিটনি! পরে হাটতে হাটতে আমি আর মেরাজ অনেকক্ষণ পরামর্শ করলাম, বাসায় গিয়েই আগে বাথরুমে চলে যাবো। সাবান দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে, জামা-কাপড় বদলে পড়তে বসে যাবো। রাতে শোয়ার আগ পর্যন্ত হু-হা দিয়ে কাজ চালাবো, পারতপক্ষে মুখ খুলবো না। আর যদি নিদেনপক্ষে ধরা খাই-ই; বলবো চা খেতে দোকানে বসেছিলাম, সেখানে কিছু খারাপ লোক সিগারেট খেয়ে ধোয়া ছেড়েছে, সেগুলো বাতাসে ভেসে ভেসে আমাদের জামা-কাপড়ে লেগেছে, তাই এই গন্ধ; জীবনে আর চায়ের দোকানে বসবো না। দেখা যাক কি হয়!

আমি তো ধরা খাইনি। মেরাজ ধরা খেয়েছিলো কিনা সেটা জানার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে পরেরদিন বিকাল পর্যন্ত। বিকালে আমরা আড্ডা দিতে বের হতাম। জিজ্ঞাসা করলাম- 'কিরে আন্টি টের পাইছে?' 'নাহ...' আমরা হাসলাম। হাসলাম কারন আমরা এখন বড় হয়ে গেছি। আমরা আর নাইনের বাচ্চাদের মতো ছোটো নেই।

 

15 June 2020

দৈনন্দিন আলাপ ৩৭


সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম সাহেবের রুহের মাগফেরাত কামনা করাকে কেন্দ্র করে জাতি আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। যেকোনো ইস্যুতে আসলে এমনটা হয়। কিন্তু বিভিন্ন ভাগে ভাগ হওয়ার আগে কয়েকটা বিষয় ভেবে নিতে পারলে ভালো হয়।

একটা ভঙ্গুর স্বাস্থ্যখাত জাতিকে উপহার দেয়ার পেছনে নাসিম সাহেবের অবদান ছিলো। তবে সে একাই এর পেছনে দায়ী না। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের প্রায় সকল সচিব ও কর্মকর্তারা এর জন্য দায়ী। নাসিম সাহেবের আগের ও পরের সকল স্বাস্থ্যমন্ত্রী এর জন্য দায়ী। দুর্নীতিবাজ সচিবদের নিয়োগ ও পদোন্নতি যারা দিয়েছে তারা দায়ী।

কে কার চেয়ে বেশি দায়ী এটা ইতিহাস ঠিক করবে। কিন্তু সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নাসিম সাহেব ইতিহাসের দায় এড়াতে পারবেন না বলেই মনে হচ্ছে। মারা যাওয়ার পর নাসিম সাহেবকে নিয়ে কথা বললে আপনার রাগ-ক্ষোভ প্রশমিত হতে পারে ঠিক, কাজের কাজ কিছু হবে না।

তাই যারা মারা যাওয়ার পর আপনি এভাবে রাগ-ক্ষোভ দেখাবেন, তারা জীবিত থাকতে থাকতেই কথা বলুন, যেনো তাদের কান পর্যন্ত কথা পৌঁছায়। যেনো জীবিত থাকতে থাকতেই তারা তাদের ধ্বংস করে ফেলা সিস্টেমের কারণে আফসোস করে।

এসময় আপনি চুপ করে থাকলে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা মনে করবে, এই জাতির সাথে দুর্নীতি করা ঠিকই আছে। যে জাতি এরকম মুহুর্তে চুপ করে থাকে দুর্নীতিতো তাদের সাথেই হবে। দুই-একজনকে জেলে নিয়ে ভয় দেখিয়ে তারা প্রমান করার চেষ্টা করবে এ জাতি ওর্থলেস- রেস্পেক্টলেস।

জাতি ওর্থলেস না। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা যেখানে গুচ্ছে থাকে, আপনি সেখানে একলা। আপনার এই একলা একলা চর্চা তাদের শক্তি যোগায়। তারা জানে আপনি কতোদূর কি করতে পারবেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে যৌথভাবে আওয়াজ তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নাই।

এরমধ্যে একটা ধর্ষণের খবর দেখলাম। একটা নাইনে পড়া বাচ্চা মেয়ে, হীরামনি। বাবা ক্যান্সারের রোগী, মা বাবার সাথে ঢাকায় হাসপাতালে, মেয়ে বাড়িতে একলা। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের এতো অবক্ষয় ঘটেছে যে আমাদের মেয়েরা রাস্তায় নিরাপদ না, বাসে-ট্রেনে নিরাপদ না, একলা কোথায় যেতে আসতে নিরাপদ না, বাসার ভেতরেও নিরাপদ না।

বেশ কয়েকজন অপরাধীদের ক্রসফায়ার চাচ্ছেন। ক্রসফায়ার তারা চাচ্ছেন রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে। দেশে আইনের শাসনের অভাব, অপরাধীদের অর্থ ও ক্ষমতার বলে শাস্তি থেকে বের হয়ে আসার প্রবণতা এবং একের পর এক ধর্ষণ আমাদের এমন দাবী করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ক্রসফায়ার কোনো সমাধান না।

কারণ আপনারা জানেন, ক্রসফায়ারকে রাজনৈতিক বিবেচনায় কতোটা ব্যবহার করা হয়। দেশে যে আইনের শাসন নাই, ক্রসফায়ার তার একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ। দাবী হওয়া উচিত- ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের আপরাধীদের দ্রুত বিচার করতে হবে। কেউ যদি অর্থ ও ক্ষমতার মাধ্যমে এটা সেটেল করতে আসে, তাকেও বিচারের মুখোমুখী করতে হবে।

কিন্তু বিচার করতে আমাদের এতো দেরী হয়ে যায় যে এর মধ্যে আর কয়টা ধর্ষন হবে কেউ জানে না। আর সেই বিচারে অপরাধীদের শাস্তি হবে না, তারা গোপনে বের হয়ে যাবে, বা ঘুষ দিয়ে বা রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে, বিচারকে প্রভাবিত করবে। আগের উদাহরণগুলো আমাদের এই ভয় দিয়েছে। সাগর-রুনি, তনুর অপরাধীদের আজও চিহ্নিত করা যায় নি। বিশ্বজিৎকে কেউ খুন করেনি। কি একটা কথা আছে না, বিচার দেরী করে হলে আর বিচার থাকেনা, বেগুনভর্তা হয়ে যায়।

এসব অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আওয়াজ তুলতে হবে। অধিকারের আওয়াজ তুলতে হবে যেনো আমরা সুশাসন নিশ্চিত করতে পারি। সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে আমরা সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ নির্মান করতে পারবো।

আগামীর বাংলাদেশ- জনতার বাংলাদেশ।
আগামীর বাংলাদেশ- দুর্নীতি ও লুটপাটমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত, আধুনিক ও কল্যানকামী বাংলাদেশ।

জয় জনতা।

13 June 2020

দৈনন্দিন আলাপ ৩৬

ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
আমাদের একপাশে স্বৈরাচারী সরকার ও তার লাগামহীন দুর্নীতি ও লুটপাট, অরাজকতা ও অব্যবস্থাপনা, জীবনের সর্বস্তরে শোষণ এবং ধনী-গরিবের বৈষম্য।
অপরপাশে দেশকে বদলানোর অফুরন্ত সুযোগ, একটি দুর্নীতি ও লুটপাটমুক্ত রাষ্ট্র, সমাজ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ, আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে চাওয়া স্বনির্ভর-স্বাবলম্বী বাংলাদেশের স্বপ্ন।
আমাদের আসলে হারানোর কিছু নাই। এর মধ্যে যা হবে সব অর্জন।
আমদের সংগ্রাম দুইটা ফ্রন্টের বিরুদ্ধে।
একদিকে সরকারের স্বেচ্ছাচার-স্বৈরাচার, দুর্নীতি ও লুটপাট, শোষণ ও বৈষম্য। অপর ফ্রন্টে জনতার মধ্যে প্রোথিত দীর্ঘদিনের অশিক্ষা-কুসংস্কার, কলোনিয়াল মানসিকতা, বৈষম্যে অভ্যস্ততা ইত্যাদি।
সংগ্রামটা সমানভাবে চালাতে হবে দুই ফ্রন্টের বিরুদ্ধে। আমরা যে আগামীর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সরকারের স্বৈরাচার ও জনতার মানসিকতার পরিবর্তন করতে না পারলে সে স্বপ্ন কখনো সফল হবে না।
প্রশ্ন হলো কোনটা আগে দরকার, কোনটা পরে দরকার! কোন সংগ্রামই অগুরুত্বপূর্ণ নয়। দুইটাই সমানভাবে চালাতে হবে। সরকারকে তার দুর্নীতিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে জনতা। আর রাষ্ট্র জনতার জন্য জনতাবাদী পলিসি বাস্তবায়ন করবে। জনতার মধ্যকার দীর্ঘদিনের বৈষম্য ও কলোনিয়াল মানসিকতা দূর করা গেলেই, জনতা আগামীর বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হবে। তার আগে জনতার প্রস্তুত হতে হবে সরকারের অসীম ক্ষমতা আর তার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে।
জনতার জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য জনতা নয়।
যে সরকার জনতার আশা-আকাঙ্খা পূরন করতে ব্যর্থ, সে সরকারের দরকার নাই। সে সরকারকে জনতা ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাড়া করাবে। আস্তাকূড়ে নিক্ষেপ করবে।
এই সংগ্রামে জয় জনতার। আগামীর বাংলাদেশ- জনতার বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ দুর্নীতি ও লুটপাটমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত, স্বনির্ভর-আধুনিক বাংলাদেশ। সমস্ত প্রতিকূলতাকে প্রবল ঝড়ের মতো ঝেরে ফেলে বাংলাদেশের জনতা নিজেদের জন্য এমন রাষ্ট্র নির্মান করবে।
কলোনিয়াল মানসিকতা আমাদের এতো দূরে নিয়ে গেছে যে, প্রতি পরিবার থেকে একজনের ভিকটিম না হওয়া পর্যন্ত আমরা চুপ থাকবো। আমাদের বাবা চিকিৎসা না পেয়ে ৮-১০ হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে রাস্তায় মরবে। আমাদের বোন ধর্ষণের পর পাশের জঙ্গলে মৃত পরে থাকবে, আর তার খুনীরা ক্ষমতা দেখিয়ে ঘুরে বেড়াবে, মামলা না করার জন্য আপনাকেই চাপ দিবে, থানা-পুলিশকে টাকা দিয়ে কিনে নিবে। আপনার ভাই কৃষক বা শ্রমিক, ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে পাউরুটি চুরি করতে গিয়ে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের পায়ের নিচে পরবে।
যতোদিন আপনি অত্যাচারিতের অনুভূতি অনুভব করতে না পারবেন, ততোদিন আওয়াজ করার দরকার নাই। কিন্তু আপনি যদি দেখে থাকেন, যা চোখের দেখা উচিত; আপনি যদি শুনে থাকেন, যা চোখের শোনা উচিত; আপনার হৃদয় যদি অনুভব করে থাকে, যা হৃদয়ের অনুভব করা উচিত, তাহলে চুপ করে থাকবেন না।
হৃদয়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে যদি আপনি বুঝতে পারেন, আপনি একটি অরাজক রাষ্ট্রে আছেন; যদি আপনি বুঝতে পারেন এমন এক দেশে আপনি আছেন, যে দেশ আপনি আশা করেন না, তাহলে আওয়াজ তুলুন। যে যার জায়গা থেকে আওয়াজ তুলুন। দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন।
আমাদের স্বামর্থ্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত হবেন না। আমাদের পূর্বপুরুষ একটা প্রশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে পরনের লুংগি গিট দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো বলেই আজ আমরা স্বাধীন। আপনার আওয়াজহীনতা স্বৈরাচারকে শক্তি জোগালে পরের প্রজন্মকে কি জবাব দিবেন, সেটা এখনি প্রস্তুত করে রাখুন।
কারণ আগামীর বাংলাদেশ- জনতার বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ দুর্নীতি ও লুটপাটমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত, স্বনির্ভর-আধুনিক বাংলাদেশ।
জয় জনতা।

2 June 2020

দৈনন্দিন আলাপ ৩৫

করোনার এই পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে আমরা জানি না। কিন্তু অর্থনীতি যেনো ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সব খুলে দেয়া হলো। খুলে দেয়ার আগে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যা জনতাবিরোধী এবং পুজিপতিবান্ধব। মানে ধনীকে আরো ধনী করো, গরীবকে আরো গরিব, এই মতাদর্শ থেকে রাষ্ট্র সরে আসেনি।
গণপরিবহন খোলা হলো। সেখানে যে দুইদিন পর থেকেই আর কেউ সামাজিক দুরত্ব মানবেনা সেটা সবাই বুঝতে পারছি। সেটা সম্ভব ও না। এতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে, গণপরিবহনের ঘাটতি সবসময়ই ছিলো। আর এসমস্ত গণপরিবহন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কতোটা উদাসীন তাও সবাই জানেন। নোংরা-অস্বাস্থ্যকর পরিবহন ব্যবস্থা আর গাদাগাদি করে নেয়া যাত্রী থেকে করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পরবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
গণপরিবহনে প্রনোদনা দিতে ব্যর্থ সরকার, যুক্তিহীনভাবে ভাড়া বাড়ালো। ৩ মাস গণপরিবহন কামাই করতে পারে নি বলে আগামি ৩ বছর কামাইয়ের পথ উন্মুক্ত করলো। এখানে লাভ কার, লস কার? যে মধ্যবিত্ত জনতা গত ৩ মাস সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছে, সে দ্বিগুন ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করবে। আর শাহজাহান খান গংরা সারা বছর ধরে তোলা শ্রমিক কল্যান চাদার টাকায় আরাম-আয়েশ করবে।
শ্রমিকের কল্যানের নামে তোলা সেই চাদার টাকা কই? গণপরিবহনে সরকারী প্রনোদনা কই? অথচ এই বৃদ্ধিকৃত ভাড়া কিন্তু শ্রমিক-ড্রাইভাররা পাবে না। পাবে মালিকপক্ষ এবং চাদাবাজ সিন্ডিকেটের লোকেরা। আর একবার এই ভাড়া বেড়ে গেলে, আর কখনো কমবে না। সব স্বাভাবিক হয়ে গেলেও এই ৩ মাস না কামাইয়ের ক্ষত সাড়বে না শাহজাহান গংদের।
সাধারণ যাত্রীর লাভ হচ্ছে না, শ্রমিকের লাভ হচ্ছে না, এমন সিদ্ধান্ত সরকার কিভাবে নেয়? এই সরকারের না মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন করার কথা। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার! ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে দিতেই নিজের শক্তি-স্বামর্থ ক্ষয় করে ফেলছে সরকার। কোন কোন সিদ্ধান্ত জনতার স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছে না।
এরপর আসে উবার, পাঠাও বন্ধ রাখার মতো গনবিরোধী প্রস্তাব। আচ্ছা গণপরিবহন, যেখানে করোনা সংক্রমণের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা, সেটা খুলে দেয়া হলো; এই সার্ভিসগুলো কি দোষ করলো? আর এসব উবার, পাঠাও বা এরকম সার্ভিস যারা দিয়ে থাকেন, তারা তো সমাজের মধ্যবিত্ত অংশই। সার্ভিস দিয়ে তারা কিছু পয়সা কামাই করে সংসার চালান। এদের সংখ্যাও নিতান্ত কম না। এসব সার্ভিসদাতাদের অর্থনীতির কথা কে চিন্তা করে দেবে?
করোনা আসার পর আমরা যেমন বুঝতে পেরেছি আমাদের স্বাস্থ্যখাত ঠিক কতোটা দুর্নীতি কবলিত, ঠিক তেমন এবার আমরা বুঝতে পারবো আমাদের পরিবহন খাত কতোটা লুটপাট কবলিত। এই দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে দেশ পেছাতে পেছাতে জাহান্নামে পরিণত হয়েছে।
আমাদের সকলের বাস এই জাহান্নামে। সবাই এই জাহান্নাম ছেড়ে যেতে চাইছে। শিকদার ভাইদের দেখেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, বাংলাদেশের থাই এম্বাসি, থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ এম্বাসি, এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ সব কেমন ম্যানেজ করে ফেললো। অথচ এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কেউ কিছু জানে না। মোর্শেদ খান স্ত্রীকে নিয়ে পুরো প্লেন ভাড়া করে পালালো। এদের সক্ষমতা আছে, এই দেশ ছেড়ে পালানোর, এরা পালিয়েছে।
আবার লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী গুলি খেয়ে মরলো। এরাও একটা ভালো জীবনের আশায়, একটু ভালো কাজ আর বেশি টাকা কামাই করার আশায় বিদেশে যেতে চাইছিলো। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি শিকদার ব্রাদার্স আর মোর্শেদ খানদের মতো দুর্নীতিবাজ আর লুটপাটকারী না হলে, বিদেশগমন খুব কঠিন। বাংলাদেশের জনতাবিরোধী সরকার জনতাকে দেখে রাখার জন্য, জনতার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ক্ষমতায় বসে নি। সরকার ক্ষমতায় বসে আছে যেনো দুর্নীতিবাজ আর লুটপাটকারীরা একটা সুশীতল ছায়ায় বসে দুর্নীতি আর লুটপাট করে যেতে পারে।
এবং এই দুর্নীতি ও লুটপাট নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। দুয়েকদিন পরপর স্যাম্পল আকারে গ্রেফতার করা হয়। কাদের গ্রেফতার করা হয় জানেন, কার্টুনিস্ট কিশোর, লেখক মুশতাক, রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুলদের মতো ভয়ংকর সব অপরাধীদের। তাদের অপরাধ কি? তারা মন্ত্রীদের নিয়ে কার্টুন আকে, তারা সেই কার্টুন শেয়ার দেয়, তারা কোথায় কতো দুর্নীতি হয়েছে সেটা নিয়ে ৩ মিনিটের ভিডিও বানায়। কি ভয়ংকর!
অন্যায় সহ্য করাও অন্যায়। এটা ভেবে অনেকে চুপ থাকেন যে মুজিবকন্যা ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু মুজিবকন্যা ক্ষমতায় থাকার সময়েই যদি দুর্নীতি-লুটপাট হয়, জনতা বিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কথা বলার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, তখন কি করবেন?! ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন, তাদের কারো অধিকার নাই, বাংলাদেশের মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেয়ার, তাদের অধিকার নাই জনতা বিরোধী এইসব সিদ্ধান্ত নেয়ার, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার।
যদি ৫ মিনিট সময় পান, ভাবুন, আপনার বাচ্চাকে আপনি কেমন বাংলাদেশ দিয়ে যেতে চান। কারণ আগামীর বাংলাদেশ, জনতার বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ- দুর্নীতি ও লুটপাটমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত, মুক্ত জনতার বাংলাদেশ।

28 May 2020

দৈনন্দিন আলাপ ৩৪


করোনা আসার পর শতশত অপকারের মধ্যে একটা উপকার হয়েছে। এই সংকট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের রাষ্ট্রের দুর্বল দিকগুলো। একটি ব্যর্থ লুটপাটবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে দীর্ঘদিন বসবাস করলেও যেনো তা বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না। অথবা নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম, সবার তো একই অবস্থা।

অথচ দেখুন, করোনা আসার পর আমাদের রাষ্ট্রের লজ্জাস্থান এক এক করে উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে। আমরা এমন রাষ্ট্রে, এমন ব্যবস্থার মধ্যেই দিনের পর দিন বসবাস করেছি। ভেবেছি এসব কথা লিখে কি লাভ! যাদের স্বামর্থ আছে তারা নিজের পরের প্রজন্মের কথা ভেবে দেশ ছেড়ে দিবে, যাদের স্বামর্থ নেই তারা চোখমুখ আরো বন্ধ করে আরো সহনশীল হয়ে উঠবে।

করোনা আসার আগে আমরা দুই মাস সময় পেয়েছি প্রস্তুতি নেয়ার। কোনো প্রকার প্রস্তুতি নেয়া হয় নি। আমাদের বর্বর মন্ত্রীসভা উঁচু গলায় বলেছে- সব প্রস্তুতি নেয়া আছে, আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। একজন মুর্খ লোক, ১৭ কোটি মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম, আমরা তা বুঝতে পারলাম। বর্বর মন্ত্রী নিজেও জানে করোনায় রাষ্ট্র কোনো প্রস্তুতি নেয়নি।

এরপর টেস্ট আর রোগী ভর্তির প্রসঙ্গ। প্রথমে বললো- কিট কম, টেস্টও কম তাই। টেস্ট যখন হওয়া শুরু করেছে দেখা যাচ্ছে ১০-২০% ই আক্রান্ত বের হচ্ছে। যারা আক্রান্ত হচ্ছে, নিজেদের ইম্যিউন সিস্টেম ভালো হলে তারা রোগমুক্ত হচ্ছে। নচেৎ অকাল মৃত্যুর দিকে ঝুকে পড়ছে। এই মৃত্যুর দায় সরকারের। এছাড়া দুইটি বিষয়। ১. করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করা, এবং ২. এই সময়ে অন্যান্য প্রায় সকল রোগের চিকিৎসা সেবা থামিয়ে দেয়া।

জনগণের পক্ষ থেকে সরকারকে মনে করিয়ে দিতে চাই চিকিৎসা সেবা আপনার মনমর্জি নয়; ইচ্ছে হলে দিবেন, না হলে দিবেন না। চিকিৎসা সেবা জনতার মৌলিক অধিকার, জনতার হক। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কোনোটাই এই মৌলিক অধিকার ধার ধারে না। অথচ বাংলাদেশের সরকার জনগণকে চিকিৎসা সেবা দিতে সম্পূর্ণ রূপে ব্যররথ-অসমর্থ। এমন সরকারকে জাদুঘরে পাঠানো ছাড়া জনতার সামনে আর কোনো উপায় খোলা নেই।

এরপর লকডাউনের নামে সিদ্ধান্তহীনতার ফাইজলামি। সিদ্ধান্তগ্রহণের জায়গায় কোন মাথামোটারা বসে আছে জানিনা, কিন্তু তারা যে এতো অপদার্থ তা করোনা না এলে জানা যেতো না। এক গার্মেন্টস খোলা আর বন্ধ করা নিয়ে নাটক করতে করতে সহ্যের সকল সীমা অতিক্রম করে গেছে তারা। সারা দেশে সমানভাবে রোগ ছড়িয়ে দেয়ার কৃতিত্ব তাই সরকারের। গার্মেন্টসের সারা বছরের লাভের টাকা, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স আর ঋণের টাকা, জনগণের ট্যাক্সের টাকা, সারা বছর সড়ক থেকে উঠা শ্রমিক কল্যান চাঁদার টাকা কোথায় যায়! সময় এসে গেছে, এসব হিসেব নেয়ার।

এরপর এরকম একটা ভঙ্গুর আর অথর্ব স্বাস্থ্যখাত নিয়ে রাষ্ট্র কিভাবে ৫০ বছর পার করলো, এ এক বিষ্ময়! সবাই হয় ঘরে বন্দী, অথবা মনোযোগ অন্য দিকে। এখনি সময় সরকারের ভাবমূর্তি পুনোরোদ্ধারের। গণতন্ত্র অনেক আগেই নিহত হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে কথা বলার অধিকারটুকু কেড়ে নিতে পারলেই দেশটা বাপদাদার রেখে যাওয়া প্লটে পরিণত হবে। দেশের যখন এমন অবস্থা, তা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না।

দেশের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে কার্টুন আঁকায় কার্টুনিস্ট জেলে যায়, সেই কার্টুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার দেয়ার লেখক জেলে যায়। সাংবাদিক জেলে যায়, শিক্ষক জেলে যায়। আর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, মজুতদার ব্যবসায়ী, সিন্ডিকেটের মেম্বার আর অথর্ব সরকারী কর্মচারি।

পুরো জাতি আজ দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে যারা মনে করছে এই স্বৈরাচার-স্বেচ্ছাচার বৈধ। তারা হয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি, দুর্নীতিগ্রস্থ আমলা, মজুতদার বা চোরাকারবারী। রাষ্ট্র যতো স্বৈরাচারী হবে ততো তাদের ব্যবসার মঙ্গল। তারা মনে করে তাদের দুর্নীতি এবং লুটপাটের বিপক্ষে কথা বলা যাবে না।

অপরদিকে ধ্বংসস্তুপের ছাই থেকে বারবার জন্ম নেয়া ফিনিক্স পাখি- জনতা। অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের যোদ্ধা তারা। এক সাড়ি জেলে গেলে অপর সাড়ি সামনে এসে দাঁড়ায়। জেল-জুলুম বা মৃত্যুর উর্দ্ধে তারা। তারা- জনতার শক্তি।

মানুষের দেহের মৃত্যু আছে, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের মৃত্যু নেই। এইরকম দুর্নীতি ও লুটপাটগ্রস্থ একটি রাষ্ট্র, বাংলাদেশী জাতি আশা করে না। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা অবশ্যই রেখে যাবো- একটি সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ।

অন্যায়-স্বৈরাচার রুখে দাঁড়ান।
দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে নিজেদের কণ্ঠস্বর একত্রিত করুন।
বিশ্বাস করতে শিখুন, আগামীর বাংলাদেশ- জনতার বাংলাদেশ।

21 April 2020

শেয়ারিং কমন মিথ- পর্ব ১


১. মিথ্রাবাদ ও খ্রিস্টিয়ান ধর্ম

মিথ্রা পারসিক ধর্মের খুবই গুরুত্বপুর্ণ একজন দেবী। পারসিকরা সূর্যের অধিষ্টাত্রি দেবী হিসেবে মিথ্রার উপাসনা শুরু করে। মানুষের মিথে সূর্য একটি বিশেষ উপাদান। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক ধর্মেই সূর্যকে উপাসনাযোগ্য হিসেবে কল্পনা করা হয়। সূর্যের সাথে জোয়ার-ভাটার সম্পর্ক, আবহাওয়ার তারতম্য, ফসলের চাষবাস, ঋতুবদল, সময়ের হিসাব, দিনরাত্রি-সপ্তাহ-মাসের হিসাব ইত্যাদি জ্ঞান মানুষ অনেক প্রাচীনকালেই আয়ত্ত্ব করে। সূর্যযে প্রাণ-প্রাচুর্যের আধার এটা বুঝতো প্রাচীনকালের মানুষেরা। আর তাই সূর্যের বিভিন্ন রূপ কল্পিত-পূজিত হয়ে এসেছে নানান যুগে, নানান ভাবে।

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রভাবশালী দেবতা মিথ্রা
মিথ্রার উৎপত্তি নিয়ে তেমন বিষদ কিছু জানা যায় না। কেবল এটুকু জানা যায় যে জরথুস্ত্র পারসিক ধর্ম প্রচারের আগ থেকেই মিথ্রার উপসনার অস্তিত্ব ছিলো। এবং মিথ্রার অপভ্রংশ মিত্রা বা মিত্র দেবতা হিসেবে ভারতেও পূজিত। অবশ্য বেদের বেশিরভাগ স্থানে মিত্রার সাথে বরুণের নাম এসেছে। ধারণা করা হয় ইরানের আহুর মাজদাই ভারতে বরুণ দেবতা। অর্থাৎ সময়ের বিচারে মিথ্রার বৈদিক হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। হিন্দু ধর্মে অবশ্য মিত্রা বন্ধুত্ব, শপথ এবং সকালবেলার সূর্যের আলোর দেবতা।

They call him Indra, Mitra, Varuna, Agni
and he is heavenly nobly-winged Garutman.
To what is One, sages give many a title
they call it Agni, Yama, Matarisvan.[1]

মিত্রা ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে ইন্দো-ইরানিয় শব্দ। এর আক্ষরিক মানে মি (বন্ধন) এবং ত্রা (যে কারণে) অর্থাৎ যে কারণে বন্ধন, ব্যবহারিকভাবে শপথ বা চুক্তি বা অঙ্গীকারকে বোঝানো হয়। ভারতে এখনো মিত্র বলতে বন্ধু-বন্ধুত্ব বোঝানো হয়। ইতিহাসে মিত্রার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ১৪ শতকে বর্তমান তুরস্কে, তখনকার এক ইন্দো-আর্য ‘মিত্তানি’ রাজার অঙ্গীকারনামায়, যেখানে সেই রাজা ইন্দ্র-মিত্রা-বরুণ-নাসাত্যা (অশ্ব বা অশ্বিনী) কে সাক্ষী রেখে অঙ্গীকার করছেন। বিভিন্ন ইরানিয় এবং আর্মেনিয় ভাষায় মিথ্রা এবং তার আধুনিক অপভ্রংশ মিহির বা মেহের মানে ভালোবাসা, স্নেহ এবং সূর্য।
ধর্ম হিসেবে পারসিক ধর্ম ইরানের রাজধর্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকে। বেদ লেখার সময়কালও মোটামোটি কাছাকাছি। কিন্তু আধ্মাত্যিক শক্তি হিসেবে মিথ্রা ও আহুর মাজদার (বরুণ) অস্তিত্ব তারও প্রায় ১-১.৫ হাজার বছর আগের। পারসিক ধর্মে মিথ্রা একজন ইয়াজাদ (উপাসনার যোগ্য সত্ত্বা)।
ইরানের রাজধর্ম হওয়ার সুবাদে পারসিক মত সারা ইরান ও তার আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে। তখনকার ইরান ছিলো আজকের ইরান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক ও আরবঅঞ্চলের কিছু অংশ। পারসিক ধর্মের সাথে ছড়িয়ে পরে মিথ্রাবাদও। তবে আলাদা মতবাদ হিসেবে ‘মিথ্রাবাদ’ কিভাবে ছড়িয়ে যায় তা অজানা। গ্রীস-ইতালিতে (রোমান সাম্রাজ্যে) এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে পুরো জরথুস্ত্রবাদ না ছড়ালেও মিথ্রাবাদ ছড়িয়ে পরে।

জার্মানির হাইডেলবার্গের নিকটে প্রাপ্ত মিথ্রা

মিথ্রাবাদ ছড়িয়ে পরার আরেকটি বড় প্রভাবক ‘মানিবাদ’। মানি (২১৬-২৭৭ খ্রিস্টাব্দ) ইরান অঞ্চলের আরেকজন নবী বা ধর্মপ্রচারক। মানি জরথুস্ত্র, গৌতম বুদ্ধ এবং যিশুখ্রিস্ট দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এই তিনজনের শিক্ষাকে একত্রিত করে তিনি প্রচার করেন মানিবাদ। মানিবাদের হাত ধরে মিথ্রা পৌঁছে যায় চীন থেকে শুরু করে রোমান সাম্রাজ্যের দূরতম প্রান্তে। রোমান সাম্রাজ্য দাপ্তরিকভাবে খ্রিস্টিয়ান ধর্মকে স্বীকৃতি দিলে বাকী ধর্মগুলোর প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসে। কিন্তু পাখি উড়ে যায়, তার পালক ফেলে যায়।
ইরানে মিথ্রা দেবী হিসেবে উপাসিত হলেও রোমান সাম্রাজ্যে মিথ্রা পরিণত হন দেবতায়। পারসিকদের ইয়াজাদ ও বিভিন্ন ফেরেশতাদের মধ্যে ৬ টি লিঙ্গের দেব-দেবতা লক্ষ্য করা যায়। পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, উভলিঙ্গ, ক্লীবলিঙ্গ, মেয়েলি-পুংলিঙ্গ এবং পুরুষালী-স্ত্রীলিঙ্গ। তৎকালীন ইরান সাম্রাজ্যের সীমানা রোমান সাম্রাজ্যের সাথে লাগোয়া ছিলো, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিলো স্বতঃসিদ্ধ।
সূর্যের দেবতা হিসেবে মিথ্রা রোমানদের সূর্যদের দেবতা হেলিয়াসের সাথে একীভূত হয়ে যান। সৌরশক্তির উপাসকরা মিথ্রা-হেলিয়াসকে এক শক্তি হিসেবে আরাধনা করতো। রোমান সাম্রাজ্যে প্রবেশের পর মিথ্রা ছড়িয়ে যায় বর্তমান ইংল্যান্ডে, তিউনিসিয়ায়। মিথ্রাবাদ সম্পর্কিত কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ না থাকায় এ মতবাদ সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। কেবল গ্রীক-রোমান ভাষ্যকারদের কাছ থেকে যতোটুকু জানা যায় আর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে যাতোটুকু পাওয়া যায়, তাই এখন ভরসা। মিথ্রা রোমান সাম্রাজ্যের সৈন্যদের মধ্যে জনপ্রিয় দেবতায় পরিণত হন। তার উপাসনার জায়গা হতো মাটির নিচে নির্দিষ্ট জায়গায়, রোমান ভাষায় বলা হতো- মিথ্রেয়াম (বহুবচন- মিথ্রেয়া)। রোমান সাম্রাজ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এরকম প্রায় ৬৮০টি মিথ্রেয়া সম্পর্কে জানা যায়।

ইতালিতে ওস্তিয়ায় প্রাপ্ত একটি মিথ্রেয়ামের অভ্যন্তর

১ম থেকে ৫ম শতক মিথ্রাবাদ রোমান সাম্রাজ্যে জনপ্রিয় মতবাদ হিসেবে জারী থাকে। তৎকালীন ঐতিহাসিক বয়ান থেকে তাদের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে কিছু জানা যায়। মিথ্রানুসারীরা পরষ্পরের সাথে দেখা হলে হাত মেলাতো। মিথ্রা এবং হেলিয়াসের হাত মেলানো একটা ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। জোতির্বিদ্যার সাথে মিথ্রার গভীর সম্পর্ক ছিলো। রোমান সাম্রাজ্যে মিথ্রা ৭ টি রূপে পূজিত হতেন। ৭টি রূপ ৭টি গ্রহের প্রতিনিধিত্ব করতো। তৎকালীন দার্শনিক পোরফাইরি (৩য়-৪র্থ শতক) এর বয়ান থেকে মিথ্রাবাদ সম্পর্কে জানা যায়-
"confirms ... that astral conceptions played an important role in Mithraism.""Hence, a place near to the equinoctial circle was assigned to Mithra as an appropriate seat. And on this account he bears the sword of Aries, which is a martial sign. He is likewise carried in the Bull, which is the sign of Venus. For Mithra. as well as the Bull, is the Demiurgus and lord of generation." (De antro nympharum 11- Porphyry)

রোমান ঐতিহাসিক প্লুটার্কের (৪৬-১২৭ খ্রিস্টাব্দ) ভাষ্যেও উঠে আসেন মিথ্রা। “They also offered strange sacrifices of their own at Olympus, and celebrated there certain secret rites, among which those of Mithras continue to the present time, having been first instituted by them.” (The Life of Pompey 26, Parallel Lives of the Noble Grecks and Romans)

রোমান সাম্রাজ্যে মিথ্রাদেবের ৭টি প্রকাশ হলো-
প্রকাশ
বাংলা
প্রতীক
গ্রহ
কোরাক্স
দাঁড়কাক
সিরামিক বা মেটালের পানপাত্র
বুধ
নিমফাস
বর
বাতি, হাতের ঘণ্টা
শুক্র
মাইলস
সৈনিক
থলি, হেলমেট, ড্রাম, বেল্ট, ব্রেসলেট
মঙ্গল
লিও
সিংহ
বজ্রপাত
বৃহস্পতি
পার্সি
ইরানি ব্যক্তি
চাঁদ, তারা, ফ্রিজিয়ান ক্যাপ
চাঁদ/সোম
হেলিওড্রোমাস
সূর্যসারথি
রোমান সূর্যদেব হেলিয়াস, চাবুক
সূর্য/রবি
পাটের (ফাদার)
বাবা/পিতা
রাখালদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বড় পোষাক, রুবির আংটি
শনি
সূত্র- M.Clauss, The Roman cult of Mithras, p.133-138

বর্তমান ইংল্যান্ডে প্রাপ্ত মিথ্রার মন্দির মিথ্রেয়াম

মিথ্রাবাদের সাথে ষাঁড়/বৃষ বধের গভীর সম্পর্ক। মিথ্রার আরাধনায় বৃষের বধ অবশ্য করণীয় ছিলো। মিথ্রার বৃষবধের সাথে জোতির্বিদ্যার সম্পর্ক ছিলো। রোমান বিভিন্ন বৃষবধের ভাস্কর্য (টাউরকটোনি) থেকে জোতির্বিদ্যার বিভিন্ন আঙ্গিকের পাঠোদ্ধার করা হচ্ছে। টাউরকটোনি থেকে প্রাপ্ত মানেগুলো আকাশের বিভিন্ন রাশিমণ্ডলী ও নিহারিকাপুঞ্জের সাথে সম্পর্কিত।

এরকম একটি তালিকা হলো-
ষাঁড়
বৃষ রাশি
সূর্য
সূর্য
চাঁদ
চাঁদ
কুকুর
ক্যানিস মেজর, ক্যানিস মাইনর
সাপ
হাইড্রা নক্ষত্রপুঞ্জ
কাক
করভাস নক্ষত্রপুঞ্জ
বিচ্ছু
বৃশ্চিক রাশি
গমের কান
স্পিসা নক্ষত্রপুঞ্জ
জমজ মশালধারক
মিথুন রাশি
সিংহ
সিংহ রাশি
গর্ত
ক্র্যাটার নক্ষত্রপুঞ্জ
গুহা
মহাবিশ্ব
সূত্র- Beck, Roger, "Astral Symbolism in the Tauroctony: A statistical demonstration of the Extreme Improbability of Unintended Coincidence in the Selection of Elements in the Composition" in Beck on Mithraism: collected works with new essays (2004), p. 257.

যাই হোক, রোমান সাম্রাজ্যে মিথ্রাবাদ শক্তিশালী মতাদর্শ হিসেবে হাজির ছিলো। কিন্তু ক্রমে খ্রিস্টিয়ানরা রোমান সাম্রাজ্যে প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। ক্রমে মিথ্রাবাদ এবং তার সাথে সম্পর্কিত আর্যদের সূর্যমিথ হয়ে যায় খ্রিস্টিয়ান ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। সেই অনুষঙ্গগুলো হলো-
ইতালিতে প্রাপ্ত মিথ্রার টাউরকটোনি

ক. কুমারী মাতা এবং অবিশ্বাস্য জন্ম
পারসিক লোককথা অনুসারে মিথ্রার জন্ম কুমারী মাতা দেবী অনাহিতার গর্ভে। তবে রোমান মিথে গিয়ে, মিথ্রার জন্ম হয় পাথর থেকে। পাথর থেকে আবির্ভূত হন মিথ্রা। খ্রিস্টিয়ান মিথেও এরকম যিশুর জন্ম দেখানো হয় কুমারী মাতা মেরীর গর্ভে। কিন্তু আমরা এখন জানি একজন মানুষের জন্ম হতে গেলে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু দুইটি অণুই প্রয়োজন।
পাথর থেকে জন্ম নিচ্ছেন মিথ্রা
যিশুর পিতৃপরিচয় বিষয়টি বাইবেলে লুকিয়ে রাখা যায় নি। মাতা মারীকে জন্মের পরপরই জেরুজালেমের মন্দিরের সেবাদাসী হিসেবে দিয়ে দেয়া হয়। মন্দিরের তত্ত্বাবধানে তখন ছিলেন প্রধান পুরোহিত শখরিয়া (আরবিতে জাকারিয়া, মাতা মেরীর খালু, জন দ্যা ব্যাপ্টাইস্ট [ইয়াহিয়া] এর পিতা)। মাতা মেরী কিশোর বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হলে এর জন্য তৎকালীন সমাজ শখরিয়াকে দায়ী করে। ইহুদি আইনে বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ককে ঘৃণার চোখে দেখা হয়, এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শখরিয়াকে ঈশ্বরের ঘর মন্দিরের বাইরের বারান্দায় পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হয়। (বাইবেল ২ বংশাবলি ২৪:২১, মথি ২৩:৩৫, লূক ১১:৫১)
যাই হোক, যিশুর অলৌকিক জন্মের ঘটনা মিথ্রার অলৌকিক ঘটনা থেকে প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে।

খ. জীবনের জন্য রুটি ও মদ
মিথ্রাবাদের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি আচার হচ্ছে জীবনের জন্য রুটি ও মদ গ্রহণ করা। মদ ক্ষেত্রবিশেষে ফলের রস বা রক্তও হতো। মিথ্রার অনুসারীরা মিথ্রেয়ামে একত্রিত হয়ে যে কয়েকটি আচার পালন করতো, যা সম্পর্কে পরবর্তীতে মানুষ জানতে পারে, তার মধ্যে এটি একটি। খ্রিস্টিয়ানরা পরবর্তীকালে এই আচারটিকে গ্রহণ করে। মিথ্রাবাদে এটি ছিলো প্রার্থনার অংশ।

গ. তিন ব্যক্তির শিশুদর্শন ও উপহার প্রদান
মিথ্রার জন্মের পর পারস্য থেকে তিন জ্ঞানী ব্যক্তি তাকে দর্শন করার জন্য আসে। তারা তাকে আশীর্বাদ করে। মিথ্রার জন্মের সময় আকাশের কিছু নির্দিষ্ট তারকা জায়গা পরিবর্তন করে, যেটা দেখে জ্ঞানী লোকেরা বুঝতে পারে, মিথ্রার জন্ম হয়েছে। যিশুর জন্ম নিয়েও একই রকম লোককথা প্রচলিত আছে।

ঘ. ১২ জন শিষ্য
মিথ্রার ১২ জন শিষ্য, যারা তাকে বছরের ১২ মাসে সঙ্গ প্রদান করে। ১২ জন শিষ্য ১২ মাসের প্রতীক। মিথ্রার বিভিন্ন উপকথা তখনকার জ্ঞানকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য শাখা জোতির্বিদ্যার সাথে সম্পর্কিত ছিলো। পরবর্তীতে ১২ জন শিষ্যের এই ধারণা খ্রিস্টিয়ানরা নিজেদের মধ্যে অঙ্গীভূত করে। যিশুর ১২ জন শিষ্য ছিলো, যা নিতান্ত কাকতালীয়।

ঙ. পানির উপরে হাঁটা
মিথ্রার মোজেজাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি  মোজেজা ছিলো তিনি যেকোনো প্রকার পানির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারতেন। যিশুর ব্যাপারেও একই রকম লোককথা প্রচলিত।
ইরানে প্রাপ্ত পাথরে উৎকীর্ন দেবী মিথ্রা
চ. মাথায় কাটার মুকুট
সূর্যের প্রকাশ হিসেবে মিথ্রার মাথায় থাকতো কাটার মুকুট। সূর্যের রশ্মিও তার মাথার চারপাশে শোভা পেতো। মিথ্রার এই রূপ বিভিন্ন খ্রিস্টিয়ান সমাজ এখনো ব্যবহার করছে। ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটা দেশ খ্রিস্টিয়ানির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছে এমন চিহ্ন, যা রোমান সাম্রাজ্যে মিথ্রার চিহ্ন হিসেবে বহুল প্রচলিত ছিলো।
মিথ্রার চারপাশে সূর্যের রশ্মি

ছ. ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এবং পুনর্জীবিত হওয়া
মিথ্রা ক্রুশবিদ্ধ হন। মিথ্রার লোককথা অনুসারে তিনি ক্রুশবিদ্ধ হন ২২ ডিসেম্বর। তিনদিন পর তিনি পুনরায় জীবিত হন ২৫ ডিসেম্বর। তারপর তিনি উর্দ্ধে স্বর্গ গমন করেন। যিশুও ক্রুশবিদ্ধ হন, তিনদিন পর পুনর্জীবিত হন এবং স্বর্গে আরোহন করেন।

জ. ক্রিসমাসে পাইন গাছ
পাইন গাছ প্রাচীন ইরানে ছিলো না। কিন্তু প্রথম বাইরে থেকে ইরানে পাইন গাছ প্রবেশ করে মিথ্রার সম্মানে। বাইরের কোনো এক রাজা দেবী মিথ্রার অনুষ্ঠানে তার মন্দিরে পাইন গাছ উপহার দেন। তারপর থেকেই পাইন হয়ে যায় মিথ্রার গাছ। সারা ইরান জুড়ে মিথ্রার মন্দিরের চারপাশে লাগানো থাকতো পাইন গাছ। প্রাচীন ইরানিরা পাইনকে পবিত্র বৃক্ষ জ্ঞান করতো। মিথ্রা রোমান সাম্রাজ্যে যে কয়েকটা বিষয় নিয়ে প্রবেশ করেন তার মধ্যে পাইন গাছ একটা।
দেবী মিথ্রা ও তার পাইন গাছ, প্রাচীন ইরানের রাজধানী পার্সেপোলিসে খোদাইকৃত

খ্রিস্টিয়ানরা ক্রিসমাসের সময় পাইন গাছকেই অলঙ্কৃত করে। পাইনগাছকে বলা হয় ক্রিসমাস ট্রি। কিন্তু কেনো পাইন ক্রিসমাস ট্রি এই বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, মিথ্রার পবিত্র গাছ পাইন, বাকি আর সমস্ত বিষয়ের মতো খ্রিস্টিয়ান মতবাদে অঙ্গীভূত হয়েছে।

ঝ. ২৫ ডিসেম্বরের জন্মদিন 
২৫ ডিসেম্বর মিথ্রার জন্ম ও একই সাথে পুনর্জীবনপ্রাপ্তির দিন। খ্রিস্টিয়ান ধর্ম প্রচলিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই মিথ্রাবাদে ২৫ ডিসেম্বরকে সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে পালন করার দলিল পাওয়া যায়। রোমান সাম্রাজ্যে সবচেয়ে বড় উৎসব হতো ২৫ ডিসেম্বর। সেসময় সৌরউপাসনার মাধ্যমে মিথ্রা-হেলিয়াসকে স্মরণ করা হতো। পুরো সাম্রাজ্যে সবার সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করা হতো।
“One of the best-known festivals of ancient Rome was “the Saturnalia”, a winter festival celebrated on December 17–24. Because it was a time of wild merrymaking and domestic celebrations, businesses, schools, and law courts were closed so that the public could feast, dance, gamble, and generally enjoy itself to the fullest. December 25—the birthday of Mithra, the Iranian god of light, and a day devoted to the invincible sun, as well as the day after the Saturnalia—was adopted by the church as Christmas, the nativity of Christ, to counteract the effects of these festivals”.[2]
Most Christians know that Yeshua (Jesus’ true name) was not born on December 25th, and that this date was instituted by the early Roman Catholic Church. The Biblical account of Christ’s birth, points out that Shepherds kept their flock out grazing in the fields on that night (Luk 2:8). Most scholars believe that He could not have even been born in the Month of December as Shepherds could and would not have taken flocks out into the fields in the cold rainy climate of winter time in the Middle East.[3]

যিশুর জন্ম ঠিক কবে তা নিয়ে বেশ কয়েকটা মতবাদ প্রচলিত ছিলো। এরমধ্যে  গবেষকরা যে সালটাকে সবচেয়ে কাছাকাছি বলে ধারণা করেন, সেটাও খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালে। সরকারীভাবে খ্রিস্টিয়ান ধর্ম রোমান সাম্রাজ্যের ধর্ম হলেও রোমানরা তাদের সবচেয়ে বড় উৎসবটিকে বাদ দিতে চাননি। যার ফলশ্রুতিতে সারা পৃথিবী জুড়ে ক্রিসমাসে আসলে পালন করা হয় মিথ্রার জন্মদিন।

কোনো অজানা স্থানে ঘুরে বেড়ানো অখ্যাত যাযাবর জাতি আর্যদের প্রাচীন দেবতা মিথ্রা, ইরান হয়ে, রোমান সাম্রাজ্য হয়ে, খ্রিস্টিয়ান ধর্ম হয়ে এখনো পালিত হয়ে যাচ্ছেন। তার নাম কেউ স্মরণে রাখুক বা না রাখুক, আচার-অনুষ্ঠান এখনো ঠিক পালিত হয়ে যাচ্ছে।



[1] Rigveda 1.164.46 (trans. Griffith)
[2] Encyclopedia Britannica, https://www.britannica.com/topic/feast-religion#toc66478
[3] https://biblethingsinbibleways.wordpress.com/tag/mithra/