11 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ১১ঃ উপনিবেশকাল ও বর্তমান উত্তরাধিকার

১১ উপনিবেশকাল বর্তমান উত্তরাধিকার
১৫২১ যিশুসনে স্পেন, ‘নতুন স্পেন’ নামে মধ্য আমেরিকা অঞ্চলে তার উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করা শুরু করে। ক্রমে মধ্য আমেরিকা মহাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চল তাদের দখলে আসে। ১৮১০ যিশুসনে এই অঞ্চলে স্পেনের সাথে স্বাধীনতাকামীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর ১৮২৪ যিশুসনে পুরো মধ্য আমেরিকার স্প্যানিশ কলোনি ‘সংযুক্ত মেহিকো রাষ্ট্র’ নামে প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বাধীন হয়। মেহিকো স্বাধীন হলেও আজটেক জাতি এবং মধ্য আমেরিকার অন্যান্য আদিবাসী-ভূমিপুত্ররা স্বাধীন হয়নি, এমনকি নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাদের।

১১. ঔপনিবেশিক শাসন
১৫২১-১৮২৪ যিশুসন পর্যন্ত আজটেকরা সরাসরি নতুন স্পেনের শাসনের যাতাকলে পিষ্ট হয়। এসময় তাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করা হয়। তাদের ভাষার উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আজটেকদের স্কুলে পড়তে হলে স্প্যানিশ ভাষায় পরতে হতো। আজটেকরা প্রায় সবাই খ্রিস্টিয়ান ধর্মে দীক্ষিত হয়। এসময় বিয়ের মাধ্যমে স্প্যানিশদের সাথে আদিবাসী জাতিগুলো মিশ্রিত হতে থাকে। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে আজটেকদের ভাষায়। আজটেক ভাষায় প্রচুর স্প্যানিশ শব্দ প্রবেশ করে। আজটেক লেখ্যরীতি পরিত্যাক্ত হয়।

তবে স্প্যানিশ সংস্কৃতিও আজটেক ও অন্যান্য আদিবাসী জাতি কর্তৃক প্রভাবিত হতে থাকে। স্প্যানিশ ভাষা, সংস্কৃতি, স্থাপত্যকলা আজটেকদের দিয়ে প্রভাবিত হয়। মিশ্র জাতি ‘মেস্টিযো’ মেহিকোতে প্রাধান্য বিস্তার করে।

১১. স্বাধীন মেহিকোতে আজটেক
১৮২৪ যিশুসনে মেহিকো স্বাধীন হলেও আজটেকরা স্বাধীন হয়নি। স্বাধীন মেহিকোতে নিজের ভাষায় পড়াশোনা করার অধিকার তাদের মেলেনি। এই অধিকার পাওয়ার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে, ২০০৩ যিশুসন পর্যন্ত। এর আগ পর্যন্ত স্প্যানিশ ছিলো একমাত্র মাধ্যম। এমনকি স্কুলে নিজেদের ভাষায় কথা না বলার বাধ্যবাধকতা ছিলো। দাপ্তরিক নথিপত্র, আইন-শালিশ, বইপত্র সবকিছুতেই ছিলো স্প্যানিশ ভাষার একক আধিপত্য। আদিবাসী ভাষাগুলোতে সাহিত্য রচনা নিরুৎসাহিত করা হতো।

১৮২০ যিশুসনে মেহিকোর প্রায় ৬০% লোক আদিবাসী ভাষাগুলোতে কথা বলতো। ২০০০ যিশুসনে সেই সংখ্যা সরকারী হিসাবমতে ৫.৪% এ এসে পৌছেছে। যদিও ১৯-২৩% নাগরিক নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবী করে, কিন্তু ভাষা হিসেবে তারা ব্যবহার করে স্প্যানিশ। মেহিকোর আদিবাসী ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক আজটেক জনগোষ্ঠীর, প্রায় ২০ লক্ষ। এরপর ইউকাতেক মায়া জনগোষ্ঠী প্রায় ৮ লক্ষ, মিহতেক জনগোষ্ঠী ৪.৫ লক্ষ এবং জাপোতেক জনগোষ্ঠী ৪ লক্ষ। মেহিকোতে স্প্যানিশদের সাথে অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর মিশ্রনকে বিভিন্নভাবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। যেমন, স্প্যানিশ + আদিবাসী = মেস্টিযো, স্প্যানিশ + মেস্টিযো = ক্যাস্টিযো, স্প্যানিশ + ক্যাস্টিযো = স্প্যানিশ ইত্যাদি।

মেহিকোর স্প্যানিশ সংস্কৃতির উপর আজটেক প্রভাব অনস্বীকার্য। অন্যান্য আদিবাসীদের তুলনায় আজটেকদের কাছ থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছে স্প্যানিশরা। মেহিকো শব্দটিই আজটেক। আজটেকরা নিজেদের পরিচয় দিতো ‘মেহিকো জাতি’ বলে। এমনকি মেহিকোর জাতীয় প্রতীকের ছবিটিও আজটেকদের ঐতিহ্য বহন করে। মেহিকোর জাতীয় প্রতীকটি তাদের জাতীয় পতাকাতেও উৎকীর্ন। সেখানে দেবতা হুইটসিলোপোশ্তলিকে (ঈগল রূপে) একটি সাপ মুখে করে নিয়ে একটা ক্যাকটাসের উপর বসে থাকতে দেখা যায়। ক্যাকটাস এখানে আজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানী তেনোশতিতলানের প্রতীক। তেনোশতিতলানই আজকের মেহিকো রাষ্ট্রের রাজধানী মেহিকো সিটি।

১১. বর্তমান পরিস্থিতি
২০০৩ যিশুসনের পর আজটেকসহ বাদবাকী আদিবাসী ভাষাগুলো মেহিকোর জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে এখন থেকে স্কুল, আদালত এবং সরকারী দপ্তরে আজটেক ভাষা ব্যবহার করা যাবে। আজটেক ভাষা শিক্ষার জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরী হচ্ছে। আজটেক ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। বর্তমান মেহিকোর তিনটি প্রদেশে আজটেকদের রাজনৈতিক অবস্থানও বেশ শক্তিশালী। এসব প্রদেশে আজটেকদের পরিমান হচ্ছে, পুয়েবলো ১৯%, গুয়েররেরো ১৭% এবং ভেরাক্রুজ ১৫%।

পরিশেষে, আজটেকরা একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অংশীদার। বিশ্বসভ্যতায় এই সংস্কৃতির অবদান নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। 

10 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ১০ঃ দৈনন্দিন জীবন

১০ দৈনন্দিন জীবন
আজটেকদের দৈনন্দিন জীবন ছিলো বৈচিত্রপূর্ণ। বিভিন্ন পেশার লোকেদের সমন্বয়ে আজটেক সমাজের জনজীবন ছিলো ঘটনাবহুল। আজটেক দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব ছিলো। আজটেক সমাজের প্রভাবশালী অভিজাত ও রাজপরিবারের সদস্যরা সাধারণ লোকেদের নাগালের বাইরে থাকলেও পুরোহিতরা ছিলেন সাধারণের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ।

১০. পরিবারব্যবস্থা
আজটেকদের পরিবারব্যবস্থা ছিলো পুরুষতান্ত্রিক কিন্তু নারী এবং বৃদ্ধদের সম্মান করার প্রচলন ছিলো শিশুদের দেবতার আশীর্বাদ মনে করা হতো আজটেক সমাজে আজটেকরা পরিবারব্যবস্থাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতো আজটেকদের পরিবার গঠনের জন্য প্রথমে পড়াশোনা শেষ করা লাগতো পড়াশোনা শেষ হবার পর পারিবারিক মতামত নিয়ে বিয়ে দেয়া হতো আজটেকদের বিয়েতে ঘটকের প্রচলন ছিলো সাধারণত দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দিত ঘটক

বিয়ের জন্য প্রথমেই শিক্ষকের অনুমতি নেয়া লাগতো ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই তার পিতামাতা এবং শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হতো বিয়ের জন্য সাধারণ বয়স ছিলো ছেলেদের ২০-২২, মেয়েদের ১৭-২০ বিয়েতে মেয়ে পক্ষের শিক্ষকরা ছেলে পক্ষের শিক্ষকদের হাতে একটা কুঠার তুলে দিতো ছেলে পক্ষের শিক্ষকরা তা গ্রহণ করলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো বিয়েতে আত্মীয়রা একত্রিত হতো নাচ এবং গানের মাধ্যমে বর-কনেকে বরন করে নেয়া হতো বিয়ে পড়ানো হতো মন্দিরে, দেবতাদের সাক্ষী রেখে। বিয়েতে বরকে ভালো স্বামী হওয়ার ব্যাপারে এবং মেয়েকে স্বামীর উত্তম সহযোগী হওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিতে হতো।

সাধারণত আজটেক সমাজ একগামী বিয়েতে অভ্যস্ত ছিলো। তবে রাজপরিবারের সদস্য এবং অভিজাতরা বহুবিবাহ করতে পারতো। বহুবিবাহ আজটেক সমাজে ছিলো বিলাসিতা। পরিবারকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, ব্যভিচারকে আজটেক সমাজে নিরুৎসাহিত করা হতো। ব্যভিচারের শাস্তি ছিলো মৃত্যুদণ্ড। আজটেক সমাজে একান্নবর্তী এবং একক দুই ধরনের পরিবারেরই অস্তিত্ব ছিলো। আজটেক সমাজে তালাকের ব্যবস্থা ছিলো। তালাকপ্রাপ্ত পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই আবার বিয়ে করতে পারতো।

১০. শিক্ষা ব্যবস্থা
আজটেক শিক্ষাব্যবস্থায় দুই ধরনের স্কুলের অস্তিত্ব ছিলো। এক- কালমেকাক, এখানে সমস্ত যাজকীয় বিদ্যা, পঞ্জিকা, জোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, গণিত, বিজ্ঞান, লোককথা, গান, নাচ, আইন এবং লেখা শেখানো হতো। আজটেক সমাজের সংস্কৃতি এবং নৈতিকতার শিক্ষাও এই স্কুলে দেয়া হতো। দুই-তেলপোশকাল্লি, এটা মূলত সামরিক স্কুল। এখানে যাজকীয় বিদ্যা বাদে বাকী সব কিছুর সাথে সামরিক শিক্ষা দেয়া হতো।

আজটেক সমাজে সমস্ত শিশুদের শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিলো। আজটেকরা মনে করতো শিশুদের শিক্ষাপ্রদান সামষ্টিক সামাজিক দায়িত্ব। তাই শিক্ষার ব্যাপারে কেবল পিতামাতার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ছিলো না। আজটেক সমাজে একজন শিশুর জন্মের পরপর তাকে কোন স্কুলে দেয়া হবে তার সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করার বয়স ছিলো ৩।

১০. খাদ্যাভ্যাস
আজটেকদের প্রধান খাদ্য ছিলো ভুট্টা। ভুট্টা থেকে উৎপাদিত হতো নানান জাতের খাবার। এছাড়া তাদের খাদ্যের তালিকায় ছিলো ম্যাগুই (আমেরিকান ঘৃতকুমারী)। ম্যাগুই থেকে আজটেকরা পোশাক নির্মানের সুতা এবং ‘অক্তলি’ নামক পানীয়ের জন্য রস সংগ্রহ করতো। অক্তলি এখনো মেহিকোতে পাওয়া যায়, তবে তাকে ডাকা হয় ‘পাল্কে’ নামে। ফল বা সবজি হিসেবে আজটেকরা গ্রহণ করতো- নোপাল ক্যাকটাস, কলা, টমেটো, মিষ্টি আলু, বিভিন্ন রকম মরিচ ইত্যাদি। প্রাণিজ খাবারের মধ্যে ছিলো বিভিন্ন রকম মাছ, হাঁস, সারসপাখি, তার্কি, হরিণ, খরগোশ, কুকুর এবং ইগুয়ানা (এক প্রকার গিরগিটি)। হাঁস এবং তার্কিকে ডিম এবং মাংসের জন্য গৃহে পালন করা হতো। সাধারণত দুইবেলা খাদ্যগ্রহন করতো আজটেকরা, সকালে এবং দুপুরে। রাতে খাবার এড়িয়ে চলতো অথবা খুব হালকা খাবার গ্রহণ করতো তারা।

১০. ক্রীড়া শরীরচর্চা
আজটেকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিলো- ‘পাতোল্লি’। পাতোল্লি ৫২ গুটির খেলা। এই খেলা অনেকটা পাশা বা লুডুর মতো। চাররঙা পাথর ব্যবহার করে চারজন খেলোয়ার এটি খেলতে পারতো। পাতোল্লির মাধ্যমে জুয়া খেলতো আজটেকরা। আজটেকদের মধ্যে পাতোল্লি ছাড়াও বিভিন্ন রকম জুয়া এবং বাজির প্রচলন ছিলো। ছাত্র এবং যোদ্ধাদের জন্য বল খেলা বাধ্যতামূলক ছিলো। এছাড়া বিভিন্ন রকম শারীরিক কসরত, কুস্তি, লাঠি নিক্ষেপ, বর্শা নিক্ষেপ, গোলক নিক্ষেপ, দৌড় এবং সাতার খেলতো আজটেকরা।

১০. গান নাচ
আজটেকরা তাদের প্রার্থনা সুর করে গাইতো। প্রার্থনা ছাড়াও তাদের মধ্যে সুর করে কবিতা পাঠের প্রচলন ছিলো। আর একপ্রকার গান ছিলো, যাকে বলা হতো- ‘কান্তারে’ বা ভুতের গান। গানের সাথেসাথে নাচেরও প্রচলন ছিলো। ছাত্রদের জন্য প্রার্থনা এবং কবিতা সুর করে গাওয়া এবং তার সাথে নাচা বাধ্যতামূলক ছিলো। আজটেকদের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে বাঁশি, ঝুনঝুনি, ড্রাম এবং শঙ্খের ব্যবহার ছিলো। তবে আজটেকদের বাঁশি, ঝুনঝুনি এবং ড্রাম ছিলো তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী তৈরী।

১০. চিকিৎসা ব্যবস্থা
আজটেকদের মতে মানুষ অসুস্থ হতো তিন কারণে। অতিপ্রাকৃত, জাদুকরী এবং প্রাকৃতিক। আজটেকরা ধারণা করতো মানুষের কৃতকর্মের শাস্তি হিসেবে দেবতারা মানুষকে অসুস্থতা দিচ্ছেন। অসুস্থতা সারানোর জন্য আজটেক পুরোহিতরা অসুস্থ মানুষের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতো। অসুস্থ মানুষ সুস্থতার জন্য দান করতো, উৎসর্গ করতো এবং পুরোহিতদের ভোজন করাতো। সুস্থতার জন্য আজটেকরা সাধারণত ভেষজ ঔষুধ গ্রহণ করতো। ভেষজ গুল্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতো- ম্যাগুই। সাহাগুনের মতে আজটেকরা চিকিৎসায় প্রায় ১৪৯ রকম ভেষজ লতা-গুল্ম-শিকড় ব্যবহার করতো।

১০. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
আজটেকদের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর ছিলো। খাদ্যদ্রব্যের সিংহভাগ নিজেরাই উৎপাদন করতো তারা। এছাড়া উদৃত্ত্ব খাদ্যদ্রব্য আশাপাশের নগররাষ্ট্রগুলোতে রপ্তানি করতো। আজটেকরা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করতো ‘কোকোয়া বীজ’ এবং তামার কুঠারের পাত। কোকোয়া বীজ হচ্ছে চকোলেট তৈরীর মূল উপাদান। কোকোয়া বীজ শুকিয়ে তাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতো তারা। তখনকার বাজারমূল্য অনুযায়ী একটুকরা জ্বালানী কাঠের দাম ১ কোকোয়া, একটা তার্কির ডিম ২ কোকোয়া, একটা আস্ত তার্কি ২০ কোকোয়া, ভূমিহীন কৃষকদের একদিনের মজুরী ৪০ কোকোয়া ইত্যাদি। 

9 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ৯ঃ পঞ্জিকা ও জোতির্বিদ্যা

পঞ্জিকা জোতির্বিদ্যা
আজটেকরা জোতির্বিদ্যায় অগ্রসর জাতি ছিলো। তাদের নিজস্ব পঞ্জিকাও ছিলো। আজটেকদের পঞ্জিকা এবং জোতির্বিদ্যা ধর্ম এবং ধর্মীয় জীবনের সাথে জড়িত ছিলো। আজটেকদের কৃষি, উৎসব, দৈনন্দিন জীবন নির্ভর করতো পঞ্জিকার উপর। আজটেকরা পঞ্জিকা পাথরে খোদাই করে রাখতো। 

. পঞ্জিকা
আজটেক পঞ্জিকায় ১৮ মাসে এক বছর। প্রতি মাসে ২০ দিন। প্রতি মাসে ৪ সপ্তাহ এবং প্রতি সপ্তাহে ৫ দিন। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে বাকী ৫ দিন নেমোন্তেমি (অশুভ দিন)। এই পাঁচ দিন আজটেকরা কিছু না করার চেষ্টা করতো। প্রতি মাসেই আজটেকদের কোনো না কোনো উৎসব থাকতো। আজটেকদের ১৮ মাস হচ্ছে- ১। আত্‌লচাহুয়ালো (১৪ ফেব্রুয়ারি - ৫ মার্চ), ২। ত্‌লাকাহিপেহুয়ালিযত্‌লি (৬ মার্চ - ২৫ মার্চ), ৩। তোযোযতোন্তলি (২৬ মার্চ - ১৪ এপ্রিল), ৪। হুয়ে-তোযোযতোন্তলি (১৫ এপ্রিল – ৪ মে), ৫। তোহকাত্‌ল (৫ মে – ২৪ মে), ৬। এতজালকুয়ালিযত্‌লি (২৫ মে – ১৩ জুন), ৭। তেকুইলহুইতোন্তলি (১৪ জুন – ৩ জুলাই), ৮। হুয়ে-তেকুইলহুইত্‌ল (৪ জুলাই – ২৩ জুলাই), ৯। ত্‌লাহোশিমাকো (২৪ জুলাই – ১২ আগস্ট), ১০। হোকোত্‌ল-হুয়েতযি (১৩ আগস্ট – ১ সেপ্টেম্বর), ১১। ওশপানিযত্‌লি (২ সেপ্টেম্বর – ২১ সেপ্টেম্বর), ১২। তেওত্‌লেকো (২২ সেপ্টেম্বর – ১১ অক্টোবর), ১৩। তেপেইলহুইত্‌ল (১২ অক্টোবর – ৩১ অক্টোবর), ১৪। কুয়েশোল্লি (১ নভেম্বর – ২০ নভেম্বর), ১৫। পানকুয়েতযালিযত্‌লি (২১ নভেম্বর – ১০ ডিসেম্বর), ১৬। আতেমোযত্‌লি (১১ ডিসেম্বর – ৩০ ডিসেম্বর), ১৭। তিতিত্‌ল (৩১ ডিসেম্বর – ১৯ জানুয়ারি) এবং ১৮। ইযকাল্লি (২০ জানুয়ারি – ৮ ফেব্রুয়ারি)বাদবাকী ৯ - ১৩ ফেব্রুয়ারি নেমোন্তেমি। চার বছর পরপর পাঁচ দিনের জায়গায় ছয় দিন নেমোন্তেমি পালন করা হতো।
 
পাথরে খোদাইকৃত আজটেক পঞ্জিকা
. জোতির্বিদ্যা
আজটেকরা জোতির্বিদ্যা কাজে লাগাতো তাদের কৃষির ক্ষেত্রে। আজটেক জোতির্বিদ-পুরোহিতরা সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্রের নিখুঁত হিসাব রাখতেন। আগের প্রজন্মের গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাব তারা পরবর্তী প্রজন্মকে দেখিয়ে দিয়ে যেতেন। আজটেকরা সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণকে বিপর্যয় হিসাবে দেখতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো এটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আলামত। আজটেক জোতির্বিদরা ঠিক কখন সূর্যগ্রহন বা চন্দ্রগ্রহন হবে তা বের করতে পারতেন। গ্রহণের সময় আজটেকরা এক জায়গায় সমবেত হয়ে ক্রন্দন করতেন এবং নিজেদের হাত-পায়ে দাগ কাটতেন। গ্রহণের সময় সবচেয়ে সাবধানে রাখা হতো প্রসূতি মায়েদের। আজটেকদের বিশ্বাস ছিলো গ্রহণ তাদের গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করে ফেলবে। 

8 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ৮ঃ ভাষা ও সাহিত্য

ভাষা সাহিত্য
আজটেক ভাষা ছিলো খুবই সমৃদ্ধ। আজটেকদের ভাষার নাম ছিলো- ‘নাহুয়াত্‌ল’ নাহুয়াত্‌ল ‘উতো-আজতেকান’ ভাষাপরিবারের সদস্য। নাহুয়াত্‌ল এখনো জীবিত ভাষা। বর্তমান মেহিকো রাষ্ট্রে নাহুয়াত্‌ল দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা, প্রথম স্প্যানিশ। নাহুয়াত্‌ল ভাষা সাহিত্যেও সমৃদ্ধ। বর্তমানে তেমন সাহিত্য রচিত না হলেও একসময় নাহুয়াত্‌ল প্রভাবশালী সাহিত্যের ভাষা ছিলো। এমনকি আশাপাশের জাতিগুলো তখন নাহুয়াত্‌ল ভাষা ব্যবহার করে সাহিত্য রচনা করতো। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও আজটেকরা মনে করতো এটা বংশানুক্রমিক, অর্থাৎ সাহিত্যের গুণ পুত্র পায় তার পিতার কাছ থেকে।

. ভাষা
আজটেকদের ভাষা এখন স্প্যানিশ দ্বারা প্রভাবিত। তবে একইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় নাহুয়াত্‌ল শব্দ আছে। সবচেয়ে বেশি নাহুয়াত্‌ল শব্দ প্রবেশ করেছে স্প্যানিশ ভাষায়। সেখান থেকে ইংরেজি ভাষায় এবং তারপর পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায়। কমপক্ষে দুইটা নাহুয়াত্‌ল শব্দ আমরা বাংলা ভাষায় প্রায় প্রত্যেকদিন ব্যবহার করি। টমেটো এবং চকোলেট। টমেটো শব্দটার মূল নাহুয়াত্‌ল- ‘তোমাত্‌ল’ এবং চকোলেট এর মূল- ‘চকোলাত্‌ল’এছাড়া স্প্যানিশ এবং ইংরেজি ভাষা আরো বিভিন্ন শব্দের জন্য নাহুয়াত্‌ল ভাষার কাছে ঋণী।

নাহুয়াত্‌ল ভাষার অনেকগুলো উপভাষা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ইশ্তমুশ, মেহিকানেরো, পিপিল, মিশোয়াকান, পোমারো, তেতেল্কিঙ্গো ইত্যাদি। দুইএকটা ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণে সামান্য তারতম্য ছাড়া উপভাষাগুলোতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এক উপভাষা ব্যবহারকারী অপরকে বুঝতে পারে এবং নিজেরা যোগাযোগ করতে পারে। আজটেক ভাষায় মৌলিক স্বরধ্বনি ছাড়াও রয়েছে ব্যঞ্জনধ্বনি। তবে আজটেকদের ব্যবহৃত নাহুয়াত্‌ল ভাষায় ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। বর্তমানে স্প্যানিশ বিভিন্ন উচ্চারন নাহুয়াত্‌ল ভাষায় প্রবেশ করেছে। আজটেকদের ব্যবহৃত নাহুয়াত্‌ল ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো হলো- ম, , , , , ক্ব, ট্‌স, ত্‌ল, ত্‌শ,, , , হ এবং য়। শব্দের শেষ ‘হ’ অনুচ্চারিত থাকতো। ত্‌ল, ত্‌শ শব্দগুলো উচ্চারণের সময় অনুরণিত হতো। ‘স’ এর উচ্চারণ ক্ষেত্রবিশেষে ‘য’ এর মতো হতো।

আজটেকরা মূল শব্দের সাথে ‘ত্‌ল’ এবং ‘ত্‌লি’ উপসর্গ যুক্ত করতো। নাহুয়াত্‌ল ভাষায় সন্ধির উদাহরণও আছেযেমন- হোশিত্‌ল মানে ফুল এবং মিল্লি মানে মাঠ বা বাগান। ফুলের বাগান হবে হোশি(ত্‌ল)+মিল্লি বা হোশিমিল্লি। আজটেকরা একটা পুরো বাক্যও এক শব্দের মতো বলতো। যেমন- মিত্‌যমোত্‌যাতযাকুইলতিতিমানিযকু অর্থাৎ তারা তোমার পক্ষে যাবে, হয় বামে নয় ডানে।

. লেখনরীতি
আজটেকদের লেখনরীতি ছিলো চিত্রভিত্তিক। প্রতিটি শব্দের জন্য একটি চিত্র। অনেকসময় একই শব্দ বিভিন্ন চিত্রে বোঝানো হতো, আবার একই চিত্র দিয়ে বিভিন্ন শব্দ বোঝানো হতো। এই ধোঁয়াশার কারণে আজটেকদের লেখনরীতি যথেষ্ট দুর্বোধ্য। আজটেকদের সময়ে সবাই লিখতে পারতো না। লেখার ক্ষমতা কাউকে কাউকে দেয়া হতো। তবে সবাই পড়তে পারতো। এখন নাহুয়াত্‌ল ভাষা লেখা হয় স্প্যানিশ বা রোমান লিপি ব্যবহার করে।

. গণনারীতি
আজটেকদের গণনা ছিলো ২০ ভিত্তিক। হাতের ১০ আঙুল এবং পায়ের ১০ আঙুল, এই থেকে আজটেকদের ২০। আজটেকদের ১-৪ পর্যন্ত গণনা ছিলো সোজা, এরপরের গণনা একটু কঠিন। তবে পাঁচটা মূল শব্দের মাধ্যমে গণনাকে সহজ করা যেতো। মূলশব্দগুলো হলো- সেম বা সেন, মাতলাক্তলি, পহুয়াল্লি, যোন্তলি এবং সিকুইপিল্লি। আজটেকদের সংখ্যাগুলো নিচে দেয়া হলোঃ

সংখ্যা
নাহুয়াত্‌ল
সংখ্যা
নাহুয়াত্‌ল
সে
২১
সেম্পহুয়াল্লিয়নসে
ওমে
২৯
সেম্পহুয়াল্লিয়নশিসোনাহুই
ইয়েই
৩০
সেম্পহুয়াল্লিয়নমাতলাক্তলি
নাহুই
৩৯
সেম্পহুয়াল্লিয়নসাহতোল্লিয়ন্নাহুই
মাকুইল্লি
৪০
ওম্পহুয়াল্লি
সিচুয়াসে
৬০
ইয়েইপহুয়াল্লি
সিচোমে
৮০
নাউহপহুয়াল্লি
সিচুয়েই
১০০
মাকুইল্পহুয়ালতেত্‌ল
সিচোনাহুই
৪০০
সেন্তযোন্তলি
১০
মাতলাক্তলি
৪০১
সেন্তযোন্তলিয়নসে
১১
মাতলাক্তলিয়নসে
৪০৫
সেন্তযোন্তলিয়নমাকুইল্লি
১২
মাতলাক্তলিওমোমে
৫০০
সেন্তযোন্তলিইপানমাকুইল্পহুয়াল্লি
১৩
মাতলাক্তলিওমেই
৮০০
ওমযোন্তলি
১৪
মাতলাক্তলিওন্নাহুই
,২০০
ইয়েতযোন্তলি
১৫
সাহতোল্লি
,০০০
মাতলাক্তযোন্তলি
১৬
সাহতোল্লিয়নসে
,০০০
সেমসিকুইপিল্লি
১৭
সাহতোল্লিওমোমে
১৬,০০০
ওমসিকুইপিল্লি
১৮
সাহতোল্লিওমেই
২৪,০০০
ইয়েসিকুইপিল্লি
১৯
সাহতোল্লিওন্নাহুই
৮০,০০০
মাতলাকসিকুইপিল্লি
২০
সেম্পহুয়াল্লি
৩২,০০,০০০
সেন্তযোনসিকুইপিল্লি

টেবিলঃ আজটেক সংখ্যা।

সংখ্যাগুলো লেখায় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ১-৪ পর্যন্ত আজটেকরা ডট ব্যবহার করতো। ১- ১ ডট, ২- ২ ডট, ৩- ৩ ডট। পাঁচে যাওয়ার পর ব্যবহার করতো একটা বক্স বা বার। আবার ৬-৯ এর ক্ষেত্রে বার এর উপর একটা ডট, দুইটা ডট। এভাবে ১০ প্রকাশ করতো একটা বারের ভিতর আরেকটা বার। ২০ ব্যবহার করতে একটা পতাকা, ৪০ দুইটা পতাকা। ৪০০ এর জন্য একটা পাতা। ৮০০ এর জন্য দুইটা পাতা।

. সাহিত্য
আজটেকদের ছিলো সমৃদ্ধ সাহিত্য সাহিত্যের মধ্যে ছিলো কবিতা প্রাচীন আজটেক সাহিত্যধারায় কবিতাই ছিলো মুলস্রোত প্রার্থনা, স্তুতি, লোককথা এমনকি দার্শনিক চিন্তাভাবনা পর্যন্ত কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো দার্শনিক চিন্তাভাবনা যারা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করতেন তাদের বলা হতো- কবি-দার্শনিক কবিতার ভাষা ছিলো সহজবোধ্য যেনো সাধারণ জনগন তা বুঝতে পারে কবিতার ভাষায় গল্প বলারও প্রচলন ছিলো আজটেক সমাজে

আজটেক সমাজের কিছু বিখ্যাত কবি এবং কবি-দার্শনিকের নাম পাওয়া যায় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- তেহকোকোর শাসক নেযাহুয়াল্কোয়োত্‌ল, তেনোশতিতলান এর  তোশিহুইতযিন, ত্‌লাতেলোল্কো এর তেমিলোতযিন, তেকামাশাল্কো এর যুবরাজ আয়োসুয়ান সুয়েতযপালিন, হুয়েহুতযিঙ্কো এর তেকায়েহুয়াতযিন, কবি-দার্শনিক সুয়াউহতেকোযত্‌লিকালের বিবর্তনে এবং স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে এখন বেশিরভাগ আজটেক কবিতাই হারিয়ে গেছে। কিছু কবিতা কেবল রয়ে গেছে আজটেকদের সমৃদ্ধ সাহিত্যের উদাহরণ হিসেবে।