১০
দৈনন্দিন জীবন
আজটেকদের দৈনন্দিন জীবন ছিলো
বৈচিত্রপূর্ণ। বিভিন্ন পেশার লোকেদের সমন্বয়ে আজটেক সমাজের জনজীবন ছিলো ঘটনাবহুল।
আজটেক দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব ছিলো। আজটেক সমাজের প্রভাবশালী অভিজাত
ও রাজপরিবারের সদস্যরা সাধারণ লোকেদের নাগালের বাইরে থাকলেও পুরোহিতরা ছিলেন
সাধারণের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ।
১০.১ পরিবারব্যবস্থা
আজটেকদের পরিবারব্যবস্থা ছিলো
পুরুষতান্ত্রিক। কিন্তু নারী এবং বৃদ্ধদের সম্মান করার প্রচলন ছিলো। শিশুদের দেবতার আশীর্বাদ মনে
করা হতো আজটেক সমাজে। আজটেকরা পরিবারব্যবস্থাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতো। আজটেকদের পরিবার গঠনের জন্য
প্রথমে পড়াশোনা শেষ করা লাগতো। পড়াশোনা শেষ হবার পর পারিবারিক মতামত নিয়ে বিয়ে
দেয়া হতো। আজটেকদের বিয়েতে ঘটকের প্রচলন ছিলো। সাধারণত দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দিত
ঘটক।
বিয়ের জন্য প্রথমেই শিক্ষকের
অনুমতি নেয়া লাগতো। ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই তার পিতামাতা এবং শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে বিয়ের জন্য
প্রস্তুতি নিতে হতো। বিয়ের জন্য সাধারণ বয়স ছিলো ছেলেদের ২০-২২, মেয়েদের ১৭-২০। বিয়েতে মেয়ে পক্ষের শিক্ষকরা
ছেলে পক্ষের শিক্ষকদের হাতে একটা কুঠার তুলে দিতো। ছেলে পক্ষের শিক্ষকরা তা গ্রহণ
করলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো। বিয়েতে আত্মীয়রা একত্রিত হতো। নাচ এবং গানের মাধ্যমে বর-কনেকে বরন করে নেয়া
হতো। বিয়ে পড়ানো হতো
মন্দিরে, দেবতাদের সাক্ষী রেখে। বিয়েতে বরকে ভালো স্বামী হওয়ার ব্যাপারে এবং মেয়েকে
স্বামীর উত্তম সহযোগী হওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিতে হতো।
সাধারণত আজটেক সমাজ একগামী
বিয়েতে অভ্যস্ত ছিলো। তবে রাজপরিবারের সদস্য এবং অভিজাতরা বহুবিবাহ করতে পারতো।
বহুবিবাহ আজটেক সমাজে ছিলো বিলাসিতা। পরিবারকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, ব্যভিচারকে আজটেক
সমাজে নিরুৎসাহিত করা হতো। ব্যভিচারের শাস্তি ছিলো মৃত্যুদণ্ড। আজটেক সমাজে
একান্নবর্তী এবং একক দুই ধরনের পরিবারেরই অস্তিত্ব ছিলো। আজটেক সমাজে তালাকের
ব্যবস্থা ছিলো। তালাকপ্রাপ্ত পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই আবার বিয়ে করতে পারতো।
১০.২ শিক্ষা ব্যবস্থা
আজটেক শিক্ষাব্যবস্থায় দুই
ধরনের স্কুলের অস্তিত্ব ছিলো। এক- কালমেকাক, এখানে সমস্ত যাজকীয় বিদ্যা, পঞ্জিকা, জোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, গণিত, বিজ্ঞান, লোককথা, গান, নাচ, আইন এবং লেখা শেখানো
হতো। আজটেক সমাজের সংস্কৃতি এবং নৈতিকতার শিক্ষাও এই স্কুলে দেয়া হতো।
দুই-তেলপোশকাল্লি, এটা মূলত সামরিক স্কুল। এখানে যাজকীয় বিদ্যা বাদে
বাকী সব কিছুর সাথে সামরিক শিক্ষা দেয়া হতো।
আজটেক সমাজে সমস্ত শিশুদের
শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিলো। আজটেকরা মনে করতো শিশুদের শিক্ষাপ্রদান সামষ্টিক সামাজিক
দায়িত্ব। তাই শিক্ষার ব্যাপারে কেবল পিতামাতার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ছিলো না। আজটেক
সমাজে একজন শিশুর জন্মের পরপর তাকে কোন স্কুলে দেয়া হবে তার সিদ্ধান্ত নেয়া হতো।
প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করার বয়স ছিলো ৩।
১০.৩ খাদ্যাভ্যাস
আজটেকদের প্রধান খাদ্য ছিলো
ভুট্টা। ভুট্টা থেকে উৎপাদিত হতো নানান জাতের খাবার। এছাড়া তাদের খাদ্যের তালিকায়
ছিলো ম্যাগুই (আমেরিকান ঘৃতকুমারী)। ম্যাগুই থেকে আজটেকরা পোশাক নির্মানের সুতা
এবং ‘অক্তলি’ নামক পানীয়ের জন্য রস সংগ্রহ করতো। অক্তলি এখনো মেহিকোতে পাওয়া যায়, তবে তাকে ডাকা হয়
‘পাল্কে’ নামে। ফল বা সবজি হিসেবে আজটেকরা গ্রহণ করতো- নোপাল ক্যাকটাস, কলা, টমেটো, মিষ্টি আলু, বিভিন্ন রকম মরিচ
ইত্যাদি। প্রাণিজ খাবারের মধ্যে ছিলো বিভিন্ন রকম মাছ, হাঁস, সারসপাখি, তার্কি, হরিণ, খরগোশ, কুকুর এবং ইগুয়ানা
(এক প্রকার গিরগিটি)। হাঁস এবং তার্কিকে ডিম এবং মাংসের জন্য গৃহে পালন করা হতো। সাধারণত
দুইবেলা খাদ্যগ্রহন করতো আজটেকরা, সকালে এবং দুপুরে। রাতে খাবার এড়িয়ে চলতো অথবা খুব
হালকা খাবার গ্রহণ করতো তারা।
১০.৪ ক্রীড়া ও শরীরচর্চা
আজটেকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়
খেলা ছিলো- ‘পাতোল্লি’। পাতোল্লি ৫২ গুটির খেলা। এই খেলা অনেকটা পাশা বা লুডুর
মতো। চাররঙা পাথর ব্যবহার করে চারজন খেলোয়ার এটি খেলতে পারতো। পাতোল্লির মাধ্যমে
জুয়া খেলতো আজটেকরা। আজটেকদের মধ্যে পাতোল্লি ছাড়াও বিভিন্ন রকম জুয়া এবং বাজির
প্রচলন ছিলো। ছাত্র এবং যোদ্ধাদের জন্য বল খেলা বাধ্যতামূলক ছিলো। এছাড়া বিভিন্ন
রকম শারীরিক কসরত, কুস্তি,
লাঠি নিক্ষেপ, বর্শা নিক্ষেপ, গোলক নিক্ষেপ, দৌড় এবং সাতার খেলতো
আজটেকরা।
১০.৫ গান ও নাচ
আজটেকরা তাদের প্রার্থনা সুর
করে গাইতো। প্রার্থনা ছাড়াও তাদের মধ্যে সুর করে কবিতা পাঠের প্রচলন ছিলো। আর
একপ্রকার গান ছিলো, যাকে বলা হতো- ‘কান্তারে’ বা ভুতের গান। গানের সাথেসাথে
নাচেরও প্রচলন ছিলো। ছাত্রদের জন্য প্রার্থনা এবং কবিতা সুর করে গাওয়া এবং তার
সাথে নাচা বাধ্যতামূলক ছিলো। আজটেকদের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে বাঁশি, ঝুনঝুনি, ড্রাম এবং শঙ্খের
ব্যবহার ছিলো। তবে আজটেকদের বাঁশি, ঝুনঝুনি এবং ড্রাম ছিলো তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী
তৈরী।
১০.৬ চিকিৎসা ব্যবস্থা
আজটেকদের মতে মানুষ অসুস্থ হতো তিন কারণে।
অতিপ্রাকৃত, জাদুকরী এবং প্রাকৃতিক।
আজটেকরা ধারণা করতো মানুষের কৃতকর্মের শাস্তি হিসেবে দেবতারা মানুষকে অসুস্থতা
দিচ্ছেন। অসুস্থতা সারানোর জন্য আজটেক পুরোহিতরা অসুস্থ মানুষের উদ্দেশ্যে
প্রার্থনা করতো। অসুস্থ মানুষ সুস্থতার জন্য দান করতো,
উৎসর্গ করতো এবং পুরোহিতদের ভোজন করাতো। সুস্থতার
জন্য আজটেকরা সাধারণত ভেষজ ঔষুধ গ্রহণ করতো। ভেষজ গুল্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি
ব্যবহৃত হতো- ম্যাগুই। সাহাগুনের মতে আজটেকরা চিকিৎসায় প্রায় ১৪৯ রকম ভেষজ
লতা-গুল্ম-শিকড় ব্যবহার করতো।
১০.৭ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
আজটেকদের
অর্থনীতি কৃষিনির্ভর ছিলো। খাদ্যদ্রব্যের সিংহভাগ নিজেরাই উৎপাদন করতো তারা। এছাড়া
উদৃত্ত্ব খাদ্যদ্রব্য আশাপাশের নগররাষ্ট্রগুলোতে রপ্তানি করতো। আজটেকরা মুদ্রা
হিসেবে ব্যবহার করতো ‘কোকোয়া বীজ’ এবং তামার কুঠারের পাত। কোকোয়া বীজ হচ্ছে চকোলেট
তৈরীর মূল উপাদান। কোকোয়া বীজ শুকিয়ে তাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতো
তারা। তখনকার বাজারমূল্য অনুযায়ী একটুকরা জ্বালানী কাঠের দাম ১ কোকোয়া, একটা
তার্কির ডিম ২ কোকোয়া, একটা আস্ত তার্কি ২০ কোকোয়া, ভূমিহীন
কৃষকদের একদিনের মজুরী ৪০ কোকোয়া ইত্যাদি।
No comments:
Post a Comment