3 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ৩ঃ আজটেক পৃথিবীর ভূগোল



আজটেক সাম্রাজ্যের মানচিত্র
আজটেক পৃথিবীর ভূগোল
ভূগোল সম্পর্কে আজটেকদের জানার পরিধি ছিলো আজকের পৃথিবীর তুলনায় সীমাবদ্ধ। আজটেকদের পৃথিবী ছিলো মূলত মধ্য ও দক্ষিণ মেহিকো। এছাড়া উত্তর মেহিকো, দক্ষিণের মায়া সাম্রাজ্য সম্পর্কেও তারা জানতো। এছাড়া জানতো তাদের সাম্রাজ্যের দুই পাশে দুইটি বিশাল জলরাশি আছে। জলরাশিকে তারা ভাবতো পৃথিবীর প্রান্ত। জলরাশির শেষ, সীমানা বা পরিমান সম্পর্কে আজটেকরা কিছু জানতো কিনা তা জানা যায়নি। আজটেকরা সবচেয়ে ভালো জানতো মেহিকো উপত্যকা সম্পর্কে। মেহিকো উপত্যকা, তার হ্রদ এবং দ্বীপ এবং এখানকার বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য সম্পর্কে আজটেকরা স্পষ্ট অবগত ছিলো।

. মেহিকো উপত্যকা
আজটেক সভ্যতার লীলাভূমি মেহিকো উপত্যকা। মধ্য মেহিকো মূলত প্রধান দুইটি পর্বতশ্রেণী দ্বারা ঘেরা। পর্বতের একপাশের সমভূমি নেমে গেছে সমুদ্রের তটরেখায়। আর একপাশে তৈরী করেছে হ্রদসহ উপত্যকা। পাহাড়ঘেরা এই হ্রদ এবং উপত্যকাই আজটেক সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। মেহিকো উপত্যকার বিশালতা সেখানে তৈরী করেছে মূলত পাঁচটি হ্রদের একটি জোট। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ‘তেহকোকো হ্রদ’। তেহকোকো হ্রদের পানি কিছুটা লবনাক্ত বাকী হ্রদগুলোতে মিষ্টি পানি বাকী চারটি হ্রদ হলো- জুম্পাঙ্গো হ্রদ, হালতোকান হ্রদ, হোশিমিল্কো হ্রদ এবং শাল্কো হ্রদ।

প্রতিটি হ্রদেই ছোটো বড় দ্বীপ রয়েছে। এছাড়া আজটেকরা হ্রদের পানির উপর নিজস্ব পদ্ধতিতে নতুন নতুন জমি বের করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলো। আজটেকরা খাবার পানির জন্য প্রধানত হোশিমিল্কো হ্রদের উপর নির্ভরশীল ছিলো এছাড়া প্রচুর পরিমান ঝর্না ও নদী ছিলো আজটেকদের পানির উৎস পুরো মেহিকো উপত্যকাই ঝর্না ও নদীতে ভরপুর ফসল উৎপাদনের জন্য তারা হোশিমিল্কো হ্রদকে বেছে নিয়েছিলো তেনোশতিতলান শহরের খাবারের প্রায় অর্ধেকই যোগান দিতো হোশিমিল্কো হ্রদের ভাসমান দ্বীপগুলো

. দ্বীপশহর তেনোশতিতলান
তেনোশতিতলান, আজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানী বর্তমান মেহিকোর রাষ্ট্রের রাজধানী মেহিকো সিটি ঠিক তেনোশতিতলানের উপর দাঁড়িয়ে আজটেক লোককথা অনুসারে, আজটেকদের প্রধান দেবতা হুইটসিলোপোশ্তলি আজটেকদের জন্য ভূমি নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। সেই ভূমিকে আজটেকরা কিভাবে চিনবে? যে ভূমিতে ক্যাকটাস গাছের উপর এসে ঈগল পাখি বসবে সে ভূমি। ঈগল পাখি মুখে ধরে রাখবে সাপ। এখানে ঈগল হলেন দেবতা হুইটসিলোপোশ্তলি। প্রতিশ্রুত ভূমির এই হলো লক্ষণ। আজটেকরা দক্ষিণে আসতে আসতে তেহকোকো হ্রদের মাঝখানের একটি দ্বীপে এই চিহ্ন দেখতে পায়। এই দ্বীপটিই তেনোশতিতলান, দেবতার প্রতিশ্রুত ভূমি।

আজটেকরা এখানে শহর গড়ে তোলে ১৩১৮ যিশুসনে। ১৩৭৫ যিশুসনে এই দ্বীপকে কেন্দ্র করে আজটেকরা গড়ে তোলে নগররাষ্ট্র। স্প্যানিশরা যখন মেহিকো এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় উপনিবেশ গড়ে তোলে, তখনও তেনোশতিতলান তার জৌলুস হারায় নি। এখন পর্যন্ত এই শহর রাজধানী হিসেবে টিকে আছে।

তেনোশতিতলানকে শহর হিসেবে গড়ে তোলা ছিলো কষ্টসাধ্য কাজ। বিশেষত খাবার পানির অভাব ছিলো প্রকট। তেহকোকো হ্রদের পানি ছিলো খাবারের অনুপযোগী। যতদিন আজটেকরা খাবার পানির সুষ্ঠু যোগানের ব্যবস্থা করতে পারেনি ততদিন আশপাশের ঝর্না আর নদী থেকে বয়ে আনা পানিই ছিলো খাবার পানির একমাত্র উৎস। দ্বীপের সীমিত পরিমান জমির মধ্যে কৃষি জমির অভাব ছিলো প্রকট। কৃষি জমির সম্প্রসারণের জন্য আজটেকরা নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

তেনোশতিতলান ছিলো পরিকল্পিত নগরী। আজটেক পরিকল্পনাবিদরা শহরকে চারভাগে ভাগ করেন। শহরের একদম মাঝখানে ছিলো আজটেকদের প্রধান মন্দির। প্রধান মন্দির মূলত ছিলো দুইটি মন্দির একসাথে। তার পাশেই ছিলো সম্রাটের প্রাসাদ। তারপর তাকে ঘিরে সরকারী দপ্তরগুলো। শহরের চারটি ভাগের ঠিক মাঝখানে ছিলো আরো চারটি মন্দির। বাজার এবং থাকার ঘরও ছিলো পরিকল্পিত জায়গায়। দ্বীপের চারপাশে ছিলো চাষের জমি। শহরে প্রবেশ করা এবং বের হওয়ার জন্য ছিলো চারটি পথ। চারটি পথ চার পাশে। চারটি পথ চারটি বড় শহরকে তেনোশতিতলানের সাথে যুক্ত করে। জায়গাস্বল্পতার কারনেই আজটেকদের নগরপরিকল্পনা ছিলো নিখুঁত

. নগররাষ্ট্র প্রতিবেশীরা
আজটেকরা যখন তেনোশতিতলানে নগররাষ্ট্র গড়ে তোলে তখন তার প্রতিবেশী শক্তিশালী জাতিগুলো হলো- উত্তরে ও পশ্চিমে তেপানেক, পূর্বে চোলহুয়া এবং দক্ষিণে হোশিমিল্কা। তেনোশতিতলানকে তার প্রতিবেশীরা ডাকতো মেহিকো-তেনোশতিতলান অর্থাৎ মেহিকো জাতির তেনোশতিতলান। প্রতিবেশী সবগুলো জাতির দখলে একের অধিক নগররাষ্ট্র ছিলো। আজটেকরাও তেনোশতিতলান শহরের পাশে আরেকটি দ্বীপে নিজেদের জন্য শহর গড়ে তোলে। তার নাম, মেহিকো-ত্‌লাতেলোল্কো। নগররাষ্ট্র থাকাকালীন সময়ে তেপানেক এবং চোলহুয়াদের সাথে আজটেকদের সুসম্পর্ক ছিলো, এছাড়া হোশিমিল্কাদের সাথে ছিলো ব্যবসায়িক সম্পর্ক।

তেনোশতিতলানের পাশের গুরুত্বপূর্ণ নগররাষ্ট্রগুলো হলো- তেপানেকদের আজকাপোত্‌যালকো, ত্‌লাকোপান, মিহকোয়াক, চোয়োয়াকান, তিজাপান, শাপুলতেপাক, আতযাকোয়াল্কো ইত্যাদি; চোলহুয়াদের চোলহুয়াকান, তেহকোকো, কোয়াতলিনশান, হুয়েশোতলা, চিমালহুয়াকান-আতেনকো ইত্যাদি এবং হোশিমিল্কাদের হোশিমিল্কো এবং শাল্কো।

সাম্রাজ্য হওয়ার পর আজটেকদের আবাসের পরিধি বেড়ে যায়। তখন তাদের প্রতিবেশী হয়- উত্তরে ওতোমি এবং হুয়াস্তেকা জাতি, পশ্চিমে চিকিমেকদের বিভিন্ন জাতি, পূর্বে ত্‌লাহকালা রাজ্য এবং মায়াদের বিভিন্ন শহর এবং দক্ষিণে মিহতেক এবং জাপাতেক জাতি। এর মধ্যে হুয়াস্তেকা এবং মায়াদের সাথে আজটেকদের শত্রুতা ছিলো। বাকী ওতোমি, ত্‌লাহকালা, মিহতেক এবং চিকিমেকদের সাথে আজটেকদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। 

No comments:

Post a Comment