6 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ৬ঃ ধর্ম, লোককথা ও সৃষ্টিতত্ত্ব

ধর্ম, লোককথা সৃষ্টিতত্ত্ব
আজটেকদের ছিলো নিজস্ব ধর্ম এবং লোককথা। আজটেক ধর্মে প্রতিবেশিদের ধর্মের প্রচুর প্রভাব থাকলেও সাম্রাজ্য হওয়ার সুবাদে আজটেক ধর্ম ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে। আজটেক দেবতারা মূলত প্রাকৃতিক শক্তি। আজটেকদের প্রধান দুই দেবতা, হুইটসিলোপোশ্তলি সূর্যের দেবতা এবং ত্‌লালক বৃষ্টির দেবতা। মেহিকো উপত্যকায় বসবাসের জন্য এই দুইটি প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্য বেশি লাগতো আজটেকদের। আজটেকদের বাকী দেবতারাও কোনো না কোনো প্রাকৃতিক শক্তি বা বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করতেন। যেমন- নদী, ভুট্টা, মদ, ফুল, ঘৃতকুমারী ইত্যাদি। মহাবিশ্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষ, জগত-জীবন ইত্যাদি সম্পর্কে আজটেক ধর্মের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো।
 
. মহাবিশ্ব এবং পৃথিবীর ধারণা
আজটেকদের ত্‌লালতিকপাক (পৃথিবী) ছিলো সমতল। আজটেকদের মতে এই পৃথিবী কেবল একমাত্র নয়। এর উপরে আছে ১৩ টি আকাশ এবং ৯ টি পাতাল। আকাশ-পৃথিবী-পাতাল ছিলো স্তরের মতো। এক স্তর তারপর আরেক স্তর। আজটেকদের মতে সবচেয়ে উপরের আকাশে বসবাস করেন সৃষ্টিকর্তা ওমেতেওত্‌ল। তার নামের অর্থ ‘দ্বৈত-স্বর্গ’। তিনি একই সাথে পুরুষ এবং নারী। তিনি বাস করেন তাই সর্বোচ্চ আকাশের নাম- ওমেয়োকান। উপর থেকে নিচে এর পরের আকাশগুলোর নাম হচ্ছে- লাল আকাশ, হলুদ আকাশ, সাদা আকাশ, বরফ এবং রশ্মির আকাশ, বাতাসের নীল-সবুজ আকাশ, ধূলার কালো আকাশ, আগুন ও ধোঁয়ার তারাদের আকাশ, লবনপানি ও পাখিদের আকাশ, সূর্য এবং ৎযিতযিমিমেদের (অশুভ নারী শক্তি) আকাশ, সিতলালিকুর (ছায়াপথ) আবাস আকাশ, বৃষ্টি এবং চাঁদের আবাস আকাশ এবং তারপর বাসযোগ্য পৃথিবী।

পৃথিবীর ছিলো চারটি কোণা (তেযকাতলিপোকা)। সৃষ্টিকর্তা ওমেতেওত্‌ল সৃষ্টি করে তেযকাতলিপোকাদের। এদের মধ্যে কালো তেযকাতলিপোকা (ধোয়াচ্ছন্ন আয়না) সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। তিনি স্বয়ং দেবতা তেযকাতলিপোকা। তিনি উত্তর দিকের রক্ষক। তার বিপরীতে আছেন সাদা তেযকাতলিপোকা, তিনি দেবতা কুয়েতজালকোয়াত্‌ল। তিনি দেবতাদের মধ্যে ভালো এবং উপকারীতিনি পশ্চিম দিকের রক্ষক। এরা দুইজন প্রায়ই সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই সংঘর্ষ থেকেই পৃথিবীর ধ্বংস এবং সৃষ্টি। ভালো-মন্দ, জন্ম-মৃত্যু এইভাবে তাদের সংঘর্ষের ফসল। এই সংঘাত পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত চলতে থাকবে।

পৃথিবীর কোণা চারটি হলেও, দিক পাঁচটি। পাঁচটি দিক হচ্ছে- পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ এবং কেন্দ্র। প্রত্যেকটি দিকের জন্য নির্দিষ্ট নির্ধারিত দেবতা ছিলেন। দেবতা ছাড়াও প্রত্যেকটি দিকের জন্য আলাদা রং, প্রতীক, গাছ ও পাখি নির্দিষ্ট করা ছিলো। পূর্ব দিকের রক্ষক দেবতা ছিলেন হিপেতোতেক, তিনি লাল তেযকাতলিপোকা। দক্ষিণ দিকের রক্ষক ছিলেন দেবতা হুইটসিলোপোশ্তলি, তিনি নীল তেযকাতলিপোকা। পৃথিবীর একদম কেন্দ্রে তেনোশতিতলানের প্রধান মন্দির অবস্থিত ছিলো। পৃথিবীর চারপাশে যেমন পানি, আকাশের চারপাশেও তেমন পানি।

আজটেকদের ৯ টি পাতালের একটি পৃথিবীতেই অবস্থিত ছিলো। পৃথিবীর পাতালগুলো হলো- পানিতে নামার পথ, পাহাড়ে ঢোকার পথ, কাচের মতো দেখতে আগ্নেয়শিলার পাহাড়, ঠাণ্ডা বাতাসের জায়গা, নরবলিকৃত হৃৎপিণ্ড যেখানে রাখা হয় এবং যেখানে মৃত মানুষকে কবর দেয়া হয়। বাকী ৮ টি পাতাল পৃথিবীর নিচে।

. সৃষ্টিতত্ত্ব মৃত্যুর ধারণা
আজটেকদের মতে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা দেবতা- ওমেতেওত্‌ল। তিনি সমস্ত দেবতাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি সূর্য, চাঁদ এবং সমস্ত তারকাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি এই পৃথিবী একবার সৃষ্টি করেন নি, বারবার সৃষ্টি করেছেন। তিনি একই সাথে ভালো এবং খারাপ। তিনি একই সাথে পুরুষ এবং নারী। সর্বোচ্চ আকাশে অবস্থান করেনতিনি তার সৃষ্টজগতকে প্রতিপালন করেন আবার ধ্বংসও করেন। তিনি তার কাজ বাকী দেবতাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন।

আজটেকরা মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাস করতো। তারা আত্মায়ও বিশ্বাস করতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো পৃথিবীতে মানুষ যা করবে তার প্রতিদান পাবে পরকালে। তবে সম্রাট, পুরোহিত এবং সাহসী যোদ্ধারা পরকালে বিশেষ সুবিধা পাবে। পৃথিবীতে দেবতাদের খুশি রাখা গেলে পরের জন্মে মানুষ ভালো থাকবে। দেবতারা খুশি না থাকলে তারা অন্ধকার পাতালে জীবনধারণ করবে।

. প্রধান লোককথাসমূহ
আজটেকদের মধ্যে লোককথা প্রচলিত ছিলো। লোককথা ছিলো ধর্মীয় জীবনের অংশ। এখন আজটেক সংস্কৃতি কেউ কেউ মান্য করলেও, লোককথাগুলো রয়ে গেছে ইতিহাস হয়ে। এগুলোর গুরুত্ব এখন কেবল পঠন-পাঠনের  মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে আজটেকদের স্বর্নযুগে লোককথাগুলোতে বিশ্বাস স্থাপন করা ছিলো পৃথিবীতে এবং পরকালে সুখে থাকার একটা অন্যতম উপায়।

৬.৩.১ ‘পাঁচ সূর্য’ লোককথা
আজটেকরা বিশ্বাস করতো এখন যে সূর্য দেখা যাচ্ছে তা পঞ্চম সূর্য। এর আগেও চারবার সূর্য তৈরী হয়েছে এবং ধ্বংস হয়েছে। চারবার সূর্যের সাথে পৃথিবীরও সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়েছে। প্রথম সূর্যকে বলা হতো, ‘মাটি বা জাগুয়ারের সূর্য’। প্রথম সূর্যের সৃষ্টিকারী ছিলেন অন্ধকারের ভয়ঙ্কর দেবতা কালো তেযকাতলিপোকা। সেখানে মানুষ বসবাস করার পরিবেশ ছিলোনা। দেবতা কুয়েতজালকোয়াত্‌ল, ভালো এবং শুভর দেবতা হিসেবে এমন পৃথিবী চাননি। তিনি কালো তেযকাতলিপোকার সাথে সংঘাতে লিপ্ত হন। সংঘাতে দেবতা কালো তেযকাতলিপোকা পেছনে হটেন এবং জাগুয়ার হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু দুই দেবতার সংঘাতে সূর্য এবং পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

এরপর দেবতা কুয়েতজালকোয়াত্‌ল দ্বিতীয় সূর্য তৈরী করেন। দ্বিতীয় সূর্যের নাম ছিলো- ‘বাতাস সূর্য’। কিন্তু দেবতা কালো তেযকাতলিপোকা পৃথিবীতে আসেন লড়াই করার জন্য। লড়াইয়ে দেবতা কুয়েতজালকোয়াত্‌ল পরাজিত হন এবং দ্বিতীয় সূর্য ঝড়ো বাতাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরপর তৃতীয় সূর্য তৈরী করেন দেবতা ত্‌লালক। তৃতীয় সূর্যের নাম ছিলো- ‘আগুন বৃষ্টির সুর্য’। কিন্তু আগুনের বৃষ্টির কারণে তাতে মানুষের জীবনধারণ করা সম্ভব ছিলোনা। আকাশ থেকে আগুন বৃষ্টি নামার কারণে সূর্য এবং পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। এরপর দেবতা ত্‌লালকের বোন দেবী শালচিউহত্‌লিকু চতুর্থ সূর্য বানানোর দায়িত্ব নেন। চতুর্থ সূর্যের নাম ছিলো- ‘পানির সূর্য’। কিন্তু তখন এক ভয়ঙ্কর মহাপ্লাবনে সূর্য এবং পৃথিবীর সবকিছু ভেসে যায়। তখন যারা মানুষ ছিলো তারা সবাই মাছ হয়ে যায়। প্লাবনের কারণে সূর্য ধ্বংস হয়ে গেলে দেবতাদের আবার প্রয়োজন পরে নতুন সূর্য বানানোর।

আজটেক সংস্কৃতিতে পাঁচ সূর্যের লোককথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আজটেকরা বিশ্বাস করতো পঞ্চম সূর্যও একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এবং তা হবে ভূমিকম্পে। আজটেকদের তখনকার বিজ্ঞান অনুযায়ী, পৃথিবী সৃষ্টির চারটি মৌলিক উপাদান দিয়েই তৈরী হয়েছিলো প্রথম চার সূর্য; মাটি, বাতাস, আগুন এবং পানি।

৬.৩.২ তেওতিহুয়াকানে পঞ্চম সূর্যের সৃষ্টি
তেওতিহুয়াকান তখন সম্পূর্ণ অন্ধকার। দেবতারা সেই অন্ধকারে একত্রিত হয়েছেন মহাবিশ্বকে আলোকিত করতে। দেবতা তেকুকিযতেকাত্‌ল স্বেচ্ছায় সূর্য হতে চাইলেন। নানাহুয়াতজিন নামে আরেক দেবতা তাকে সঙ্গ দিতে রাজি হলেন। সূর্য হতে চাইলে তাদেরকে উৎসবের অগ্নিতে আত্মাহুতি দিতে হবে। কিন্তু উৎসবের অগ্নির কাছে গিয়ে দেবতা তেকুকিযতেকাত্‌ল ভয় পেয়ে যান। তাই নানাহুয়াতজিন প্রথমে আগুনে ঝাপ দেন। এরপর তিনি সূর্য হিসেবে আকাশে চলে যান। তখন তার নাম হয়- ‘তোনাতিউহ’। তার দেখাদেখি তেকুকিযতেকাত্‌লও আগুনে ঝাপ দেন। তিনি চাঁদ হিসেবে আকাশে যান। প্রথমে তাদের দুইজনের উত্তাপ একই রকম ছিলো। দেবতারা নানাহুয়াতজিনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে চাঁদের গায়ে খরগোশ পাঠান। সেই খরগোশ চাঁদের কিছু আলো খেয়ে ফেলে তাকে এখনকার মতো করে দেয়। এখনো চাঁদের গায়ে সেই খরগোশকে দেখা যায়।

দেবতা তোনাতিউহ তখন দেবতাদের কাছে রক্ত অর্ঘ্য চান। দেবতারা পঞ্চম সূর্যের টিকে থাকার স্বার্থে নিজেদের হৃৎপিণ্ড অর্ঘ্য হিসেবে দিতে চান। দেবতারা সবাই আবার তেওতিহুয়াকানে জমায়েত হন। তাদের হৃৎপিণ্ড বের করার দায়িত্ব দেয়া হয় দেবতা কুয়েতজালকোয়াত্‌লকে। দেবতাদের হৃৎপিণ্ড বের করা শেষ হলেও দেবতা তোনাতিউহ সন্তুষ্ট হন নি তিনি আরো রক্ত চাইলে দেবতারা বলেন, আবার মানুষ তৈরী করা হোক এবার মানুষ দেবে সূর্যের প্রতি অর্ঘ্য

.. প্রথম মানুষ এবং ভুট্টা আবিষ্কার
পঞ্চম সূর্য মানুষের রক্ত অর্ঘ্য হিসেবে দেবতাদের কাছে চায়। দেবতারা কুয়াতজালকোয়াত্‌লকে দায়িত্ব দেন আবার মানুষ তৈরী করার জন্য। দেবতা কুয়াতজালকোয়াত্‌ল তখন মিক্তলান (পাতাল) যান চতুর্থ সূর্যের সময়কার মৃত মানুষের হাড়গোড় (যারা মাছ হওয়ার আগেই মারা গিয়েছিলো) আনার জন্য। সেখানে পাতাল রক্ষাকারী দেবতা মিক্তলানতেচুতলি এবং তার স্ত্রী দেবী মিক্তলানচিহুয়াত্‌ল তাকে মানুষের হাড়গোড় দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে অনেক অনুরোধের পর এক শর্তে তারা হাড়গোড় দিতে রাজী হন। শর্ত হচ্ছে দেবতা কুয়াতজালকোয়াত্‌লকে পাতালের চারপাশে শঙ্খ বাজাতে হবে। শঙ্খ দেয়া হলে দেবতা দেখতে পান সেখানে কোনো গর্ত নেই। তাহলে তিনি কিভাবে ফুঁ দিয়ে শঙ্খ বাজাবেন? দেবতা তখন মৌমাছিদের বলেন শঙ্খে একটা গর্ত করে দেয়ার জন্য যেনো তিনি তা বাজাতে পারেন। মৌমাছি গর্ত করে দেয়ার ঘটনা পাতালের রক্ষাকর্তা দেবতা জেনে যান, তিনি ক্রুদ্ধ হন। তিনি পাতালের আরো গভীরে একটি কূয়ায় দেবতা কুয়াতজালকোয়াত্‌লকে বন্দী করেন। কিন্তু দেবতা বুদ্ধি খাটিয়ে সেখান থেকে পলায়ন করেন এবং চতুর্থ সূর্যের সময়কার মানুষের হাড়গোড় পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। এসময় কিছু হাড়গোড় ভেঙে যায়। একারনেই পঞ্চম পৃথিবীতে মানুষের বিভিন্ন রকম আকার।

তারপর সেই হাড়গোড়ের উপর দেবতারা তাদের রক্ত ছিটীয়ে দেন। সেই রক্তে পুরাতন হাড়গোড় সজীব হতে শুরু করে। হাড়ের উপর দেখা দেয় মাংস, তার উপর চামড়া। জন্ম নেয় পঞ্চম পৃথিবীর প্রথম মানুষ- চিপাকতোনাল এবং ওশোমোকো।

তখন পৃথিবীর সব বীজ সংরক্ষিত ছিলো তোনাকাতেপেত্‌ল পাহাড়ে। সেই পাহাড়কে বলা হতো, খাদ্যের পাহাড়। তবে সেই পাহাড়টি বন্ধ ছিলো। দেবতা কুয়েতজালকোয়াত্‌ল তখন পিঁপড়ায় পরিণত হন। পিঁপড়া হয়ে তিনি সেই পাহাড়ে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি ভুট্টার বীজ একত্রিত করেন। যে ভুট্টা পরে পঞ্চম পৃথিবীর মানুষের প্রধান খাদ্য হবে। তারপর দেবতা নানাহুয়াতজিন তোনাকাতেপেত্‌ল পাহাড়কে বলেন খুলে যেতে যেনো মানুষেরা চাষবাস করার জন্য বীজ পায়। পরে বৃষ্টির দেবতা ত্‌লালকের সাহায্য নিয়ে দেবতা নানাহুয়াতজিন সেই পাহাড় খুলতে সক্ষম হন এবং পৃথিবীর মানুষ চাষ করার মতো বীজ পায়।

এই পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করতে এবং টিকিয়ে রাখতে দেবতারা অনেক পরিশ্রম করেছেন। তাদের এই পরিশ্রমের বিনিময় কখনোই দেয়া সম্ভব নয়। দেবতারা এর প্রতিদানে চান মানুষের আনুগত্য এবং রক্তার্ঘ্য। দেবতাদের খুশি রাখার জন্যই আজটেক সমাজে নরবলির মাধ্যমে রক্তার্ঘ্য উপহার দেয়া প্রচলিত হয়।

. আজটেক দেবতা
আজটেক দেবতারা ছিলেন অমর। তারা মানুষের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতেন। সাধারণত তাদের বিভিন্ন প্রাণী বা চিহ্ন বা মানুষের আকৃতিতে প্রকাশ করা হতো। এছাড়াও একই দেবতার বিভিন্ন রকম নাম ছিলো। দেবতারা অনেক সময় অঞ্চলভিত্তিক হতেন। অনেক সময় বিজিত অঞ্চলের দেবতাদের আজটেকরা নিজেদের দেবতাদের সাথে অঙ্গীভূত করে নিতো। এসব কারণে আজটেক দেবতাদের সঠিক সংখ্যা নির্নয় করা প্রায় মুশকিল। তবে বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানী এবং গবেষকরা আজটেকদের মোট আরাধ্য দেবতাদের সংখ্যা নির্ধারন করছেন ১৬৬। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ন, শক্তিশালী এবং আজটেকদের দৈনন্দিন আরাধ্য দেবতার সংখ্যা সাকুল্যে ১৫।

আজটেকদের প্রধান দেবতা ছিলেন- হুইটসিলোপোশ্তলিতিনি আজটেকদের রক্ষাকারী দেবতা। তিনি সূর্য, যুদ্ধ এবং আগুনের দেবতা। তারপর আজটেকদের প্রধান দেবতা ছিলেন- ত্‌লালক। তিনি পানি, বৃষ্টি এবং বীজের দেবতা। তার নামে মেহিকোতে একটি পাহাড় আছে। আজটেকদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাবশালী দেবতা ছিলেন- ওমেতেওত্‌ল। তিনি আজটেকদের সৃষ্টিকর্তা দেবতা। তিনি আজটেকদের পালনকর্তাও। তারপর তেযকাতলিপোকা। তিনি অমঙ্গল এবং অশুভের দেবতা। আজটেকরা তার আরাধনা করতো যেনো তাদের জীবনে কোনো অমঙ্গল না আসতে পারে। দেবতা কুয়েতজালকোয়াত্‌ল। তিনি মানুষের স্রষ্টা। তিনি বাতাস এবং মঙ্গলের দেবতা। দেবী চিহুয়াকোয়াত্‌ল, তিনি পৃথিবীর দেবী। দেবী চিকোমেকোয়াত্‌ল, তিনি খাদ্যের দেবী। দেবী হোশিকুয়েতজাল, তিনি শিল্পী, শিশু, ভালোবাসা এবং বিনোদনের দেবী। দেবতা হিপেতোতেক, তিনি ঝর্না, পুনর্জন্ম, কৃষি এবং স্বর্নকারদের দেবতা। দেবতা হোশিপিল্লি, তিনি ফুলের দেবতা। দেবতা সিনতেওত্‌ল, তিনি ভুট্টার দেবতা। দেবতা মিহকোয়াত্‌ল, তিনি শিকারের দেবতা। দেবতা তেযকাতযোনকাত্‌ল, তিনি মদের দেবতা। দেবতা ইয়াকাতেচুতলি, তিনি ব্যবসায়ী এবং ভ্রমনকারীদের দেবতা। এছাড়া আরো অনেক গৌণ দেবতা রয়েছেন।

. ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান
আজটেকদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ছিলো মূলত নরবলিকে কেন্দ্র করে। প্রতি মাসেই আলাদা দেবতার উদ্দেশ্যে নরবলি দেয়া হতো। নরবলি সংগ্রহ করা হতো সাধারণত যুদ্ধবন্দীদের থেকে। তাদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা থাকতো। তবে যে কেউ নিজেকে দেবতার প্রতি উৎসর্গ করতে পারতো। স্বেচ্ছা-উৎসর্গীকৃত আজটেককে বলি দেয়া যেতো। আচার অনুষ্ঠান দিনে ও রাতের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হতো। কেবল তেনোশতিতলানের প্রধান মন্দির নয়, আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানে আলাদা জায়গায় নরবলি দেয়ারও বিধান ছিলো।

৬.৬ মৃত্যুপরবর্তী জীবন প্রথা
আজটেকরা মৃত্যুর পরের জগতে বিশ্বাস করতো। তারা বিশ্বাস করতো কাজের ফলাফল দেবতাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে। পৃথিবীকে তারা মনে করতো- মাতা। ফলে মৃত্যুকে আজটেকরা নিজের মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার মতো মনে করতো। কেউ যদি শিশু অবস্থায় মারা যেতো তার জন্য আকাশে একটি স্বর্গীয় গাছের (চিচিহুয়াকুয়াউহকো) ব্যবস্থা করা হতো। সেই গাছে শিশুদের লালনপালনের জন্য স্তনের ব্যবস্থা থাকতো। যোদ্ধাদের জন্য মৃত্যুর পর দেবতারা সুব্যবস্থা রাখবেন বলে ধারণা ছিলো। এছাড়া যেসব নারী ও পুরুষ, কুমারী ও কুমার অবস্থায় মারা যেতো তাদের জন্যও থাকতো দেবতাদের আশীর্বাদ।

আজটেক ধর্মে মৃত্যুর পর স্বর্গের অস্তিস্ত্ব ছিলো। আজটেকদের স্বর্গের অবস্থান সর্বোচ্চ আকাশে। আজটেকদের স্বর্গ যেনো সাজানো বাগান। আজটেকদের স্বর্গ নানান জাতের ফুল ও ফলের গাছে সুশোভিত থাকবে। সেখানে থাকবে নানান জাতের শষ্য ও বীজ। এবং থাকবে উষ্ণ বৃষ্টি। সেখানে সবাই তাদের পরিবারের সাথে মিলিত হবে। মৃত শিশুদের তাদের মায়েদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে। মৃত যোদ্ধাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে তাদের পিতার কাছে।

আজটেক ধর্মীয় জীবনে নরকেরও অবস্থান ছিলো। নরক ছিলো সবচেয়ে নিচের পাতালে। সেখানে পাতালের রক্ষাকারী দেবতা অশুভ আত্মাদের শাস্তি দিবেন। সেখানে তাদের উলঙ্গ অবস্থায় ঠাণ্ডা নদী সাঁতরে পাড়ি দিতে হবে। সেখানে বড় বড় পাহাড় তাদের উপর ভেঙে পরবে। সেখানে প্রত্যেকদিন জাগুয়ার এবং গিরগিটি তাদের হৃৎপিণ্ড খেয়ে ফেলবে। নরকের শাস্তি চলতেই থাকবে।

মৃত আজটেকদের দুইভাবে সৎকার করা হতো। এক- কবর দেয়া হতো। কবর দেয়া হতো আজটেক সাধারণ জনগনকে। এছাড়া শিশু, অবিবাহিত যুবক-যুবতী, সন্তান জন্ম দেয়ার সময় মৃত মায়েদেরও কবর দেয়া হত। কবর দেয়ার পর তাদের আত্মা চার বছর ত্‌লালকের পাহাড়ে অবস্থান করতো। তারপর সেখানে তাদের আত্মীয়রা মৃতের বিশেষ ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করার পর, আত্মা মুক্ত হয়ে স্বর্গে গমন করতো। দুই- আগুনে পোড়ানো হতো। আগুনে পোড়ানো হতো রাজপরিবারের সদস্যদের, গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত এবং যোদ্ধাদের। আজটেক ধর্মে আগুন স্বয়ং দেবতা হুইটসিলোপোশ্তলি। তাই আগুনে পোড়ানোর মাধ্যমে মৃতের আত্মা দেবতার কাছে সরাসরি সমর্পন করানো হতো।

No comments:

Post a Comment