10 April 2020

দৈনন্দিন আলাপ ৩২

মানুষের জীবন আসলে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। আর মাঝখানের যতো কর্মতৎপরতা তা কেবল জীবন যাপন। দুই বেলা খাওয়া, এক বেলা ঘুম আর একটি নির্ঝঞ্জাট জীবিকা নির্বাহ করতে করতে মানুষের সারা জীবন কেটে যায়। মানুষ কেবল দৌড়ে বেড়ায়। এই দৌড় গন্তব্যহীন, কোথাও পৌঁছানোর জন্য নয়। মানুষ আসলে জানেই না সে কোথায় পৌঁছাতে চায়। মানবজাতির বেশিরভাগ সদস্য সারাজীবন হয়ত একবারের জন্যও ভাবেনা, কিসের জন্য তার এই জীবন যাপন!
যাই হোক, তবু মানুষ দৌড়ায়, জন্ম নেয়, মৃত্যুবরণ করে। এখন সারা পৃথিবী জুড়ে একটি মহামারী চলছে। এই মহামারী মানবজাতিকে বলেছে- ‘থাম’। মানুষ থেমে গেছে, মানুষের জীবন থেমে গেছে, মানুষের জীবিকা থেমে গেছে। থেমে থেকেও যে জীবন চলে যায়, ধীরে ধীরে শিখছি। এর আগেও বাসায় ছিলাম, কিন্তু কখনো এরকম বাসা থেকে বের হতে ভয় পায়নি মানুষ; কখনো মনে হয় নি, বাইরে যাওয়া যাবে না। বাইরে মহামারী, বাইরে মৃত্যু!
মৃত্যুকে এতো ভয় মানুষের! অথচ জন্মের পর এই মৃত্যুই তার জীবনের একমাত্র সত্য। প্রত্যকে জীবিত প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অথচ সেই মৃত্যুকে ভয় পেয়েই আমাদের জীবন যেনো থমকে গেছে।
এই মহামারী আমাদের বেশ কয়েকটি শিক্ষা দিয়ে যাবে। এই শিক্ষা, প্রকৃতির শিক্ষা। যে শিক্ষা পেতে সারা পৃথিবীর মানুষের হয়ত ১০০ বছর লাগতো, সেটাই এখন ৩ মাসে পেয়ে যাচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে, এই ভোগবাদী-পুঁজিবাদী সমাজে অন্য মানুষের কাজে আসা, সেবা করাই আসলে মানুষের আসল কাজ। কোনো মানুষ একলা বা আলাদা নয়। সমগ্র মানব জাতিই একটি একক সত্ত্বা।
তাই এই পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় যে কারো বিপদ মানেই মানবজাতির বিপদ। এটা যতো তাড়াতাড়ি মানুষ বুঝতে পারবে ততোই মঙ্গল। জন্ম সত্য, মৃত্যু সত্য, আর এই দুইয়ের মাঝখানে মানুষের সেবা সত্য। আরেকটা দিক যেটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, তা হলো- মানুষ মানুষকে মারার জন্য, দমন-পীড়ন করার জন্য যে অস্ত্র মজুদ করে তা শুধুশুধু, অপচয়। বরং সে অর্থ ব্যয় করা উচিত সমগ্র মানব জাতির কল্যানে। মানব জাতির সকল সদস্য শিক্ষা-দীক্ষায় সমান ভাবে অংশগ্রহণ করবে, সমান স্বাস্থ্যসেবা পাবে। কেউ না খেয়ে থাকবেনা, কেউ খোলা আকাশের নিচে থাকবেনা, সবাই সম্মানজনকভাবে বাঁচবে, জীবনধারণ করবে।
যদি কখনো এরকম হয়, তবেই মানুষের জীবন স্বার্থক হবে। অন্যথায় মানুষ কেবল একটি জৈব-মাংসপিণ্ডের বেশি কিছু নয়।
আরেকটি প্রসঙ্গ, এই মহামারীতে যারা মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, এমনকি পেশাগত কারণে, তাদের ধন্যবাদ। চিকিৎসক-নার্স ও পরিচ্ছন্নকর্মীরা সেবা দিচ্ছেন, পুলিশরা আমাদের দেখভাল করছেন, সাংবাদিকরা খবরাখবরের প্রবাহ নিশ্চিত করছেন, ব্যাংকাররা লোকজনের অর্থের দেখভাল করছেন, স্বেচ্ছাসেবকেরা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে মানুষের দরজায় দরজায় সেবা পৌছে দিচ্ছেন।
তবে যারা মূলগতভাবে অসৎ মানুষ তারা এই বিপদের সময়েও সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষের হক নষ্ট করে তারা কতোদূর কি করবে আমি বুঝিনা! তাদের প্রকৃতির বিচারের কাছে সোপর্দ করলাম। আর যদি কখনো মহামারী শেষ হয়, জনতা নিজের বুঝটা বুঝে নিতে পারে, এইসব দুর্নীতিবাজ, লুটপাটকারীরা চিহ্নিত হয়ে থাকলো সেদিনের জন্য।
মানুষের সমাজের তিনটি শ্রেণী, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাদের। তাদের ছাড়া মানবজাতি ১ বছরও এই গ্রহকে টিকাতে পারবে না, অথচ তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত-নিগৃহীত। আবার তারা নিজেরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়, তারা যুথবদ্ধ নয়, নিজেদের চাওয়া-পাওয়া নিজেরা ব্যক্ত করতে পারে না। তাই মানবজাতির সচেতন অংশের উচিত সেই মানুষদের পক্ষ নেয়া; সেই মানুষদের মুখ হয়ে কথা বলা, সেই মানুষদের কণ্ঠ হয়ে স্লোগান হওয়া, সেই মানুষদের হাত হয়ে অধিকারের জন্য লড়াই করা।
মানবজাতির সেই শ্রেণীগুলো হলো- কৃষক, মজুর ও শ্রমিক। এদের হক নষ্ট করার আগে একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন, কোনোদিন কোনো কৃষক, লুটপাট হবে ভেবে, কৃষিকাজ বন্ধ করেছে কিনা! কোনো মজুর মাটি কাটা বন্ধ করেছে কিনা, কোনো শ্রমিক উৎপাদন বন্ধ করেছে কিনা! দিন থেকে রাত, মাসের পর মাস এরা সমাজ আর মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আর বিনিময়ে যাদের সক্ষমতা আছে তারা তাদের হক লুট করছে, দুর্নীতি করছে।
এই মহামারী এবার আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, প্রকৃতির চোখে কোনো ধনী-গরিব নেই, কোনো পুঁজিপতি-মজুর নেই, কোনো ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-বয়স নেই। প্রকৃতি সবার জন্য সমান। এই প্রকৃতির আলো-বাতাস-পানি-মাটি, অক্সিজেন ইত্যাদি যেমন কোনো মানুষ বা অন্য প্রাণী বিভেদ করে না; তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারীও বিভেদ করে না।
আসলে আমার মনে হয়, পুরো প্রাণীজগতই একক একটি সত্ত্বা। সবাই সবার উপর নির্ভরশীল। গাছ অক্সিজেন দেয়, আমরা নেই; আমরা কার্বন-ডাই-অক্সাইড দেই, গাছ নেয়। এইভাবে দেয়া আর নেয়ার মধ্যেই প্রকৃতির ব্যালেন্স টিকে থাকে। একদিন মহামারী শেষ হবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে, তবে সেটা দেখার জন্য টিকে থাকবো কিনা, জানি না এখনো।

No comments:

Post a Comment