20 April 2020

শেয়ারিং কমন মিথ


শেয়ারিং কমন মিথ
বিহাইন্ড দ্যা স্টোরি অব কমপ্যারাটিভ রিলেজিওন

মিথ সাধারণত শেয়ার করারই বিষয়। মিথের গল্পগুলো মহামারীর মতো ছড়িয়ে পরে অতি দ্রুতবেগে মানুষের মুখে মুখে। তারপর সেই মিথের সাথে মিশে যায় সংস্কৃতি, প্রচলিত ধর্ম আর আচার-ব্যবহার। মিথ ডালপালা গজায় ঐ অঞ্চলের আলোবাতাস অনুযায়ী। মিথের সাথে মানুষ একাত্মতা পোষণ করে। মিথ তাই বয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। পুরো মানবজাতি একক ইউনিট হিসেবে এই মিথের হকদার।
কমন মিথের বিষয়টি প্রথম খেয়াল করি, বাইবেল পড়তে গিয়ে। এর আগে কোরআন পড়া ছিলো। বাইবেল পড়তে গিয়ে দেখি, আরে এদের তো আমি পড়েছি, তবে একটু ভিন্নভাবে। সেই আদম, হাওয়া, নুহ, ইব্রাহীম, ইসহাক, দাউদ। বাইবেলে প্রথম অংশ, ওল্ড টেস্টামেন্টই নাকি তৌরাত, ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ। সেমেটিক ধর্ম হওয়ায় এদের মিথে মিল থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এই ধর্মের বিভিন্ন বিষয় জরাথুস্ত্রের ধর্মের সাথে মিলতে থাকে। পরে পড়তে গিয়ে দেখি জরাথুস্ত্রের পারসিক ধর্ম আর হালের হিন্দু ধর্মের রুট নাকি একই, বৈদিক ধর্ম। মানে ধর্মগুলো যতোই নিজেদের আলাদা বলুক না কেন, তারা আসলে একই গাছের বিভিন্ন শাখা। আমরা ক্ষুদ্রজ্ঞানে এক ডালে বসি, আরেক ডালকে দেখতে পাইনা, আর গালমন্দ করি।
কমন মিথগুলো শেয়ার করা একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। কেউ যে ইচ্ছা করে এমনটা করে তা নাও হতে পারে। না চাইতেও অন্যদের ভালো গল্পগুলো আপনি উদাহরণ হিসেবে নিয়ে নিতে পারেন, অবচেতনভাবে। এমনো মিথ আছে যেগুলো ছাড়া ধর্মের মূল ভিত্তিই দাঁড়া হবে না, আপনি না চাইলেও আপনাকে নিতে হবে। এভাবেই মানুষের জ্ঞানকাণ্ড ছড়িয়ে গেছে, মানুষ হয়ে উঠছে সমৃদ্ধ।
রিলিজিওনের আলাপে যাওয়ার আগে বলে নিতে চাই, ধর্ম হিসেবে পারসিক এগুলোর মধ্যবর্তী জায়গায় পরে। স্থান হিসেবে যেমন ইরান ভারত আর মধ্যপ্রাচ্যের মাঝখানে, তেমন চিন্তা-সংস্কৃতির হিসেবেও পারসিক ধর্ম বৈদিক চিন্তাধারা আর সেমেটিক চিন্তাধারার মধ্যবর্তী অবস্থানে। মানুষের ইতিহাসে আরেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা-দর্শন-ধর্ম বৌদ্ধও ভারতীয় ধর্ম। 
জরথুস্ত্রবাদ ‘মতবাদ’ হিসেবে এতো বিশাল আর বাংলাভাষায় এটা নিয়ে এতো কম কাজ হয়েছে যে কোনটা নিয়ে আগে কথা বলবো সন্দেহে পরতে হয়। ধীরে ধীরে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে এই মতবাদকে বাংলাভাষী পাঠকের সাথে পরিচিত করিয়ে দিতে পারলে ভালো লাগবে।
পারসিক বা জরথুস্ত্রবাদ বা মাজদায়াস্না বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন ধর্মগুলোর একটি। পারসিক দ্বিঈশ্বরবাদী ধর্ম। আহুর মাজদা মঙ্গলের ঈশ্বর এবং আহরিমান (আভেস্তান- অংরা মাইন্যু) অশুভের ঈশ্বর। পারসিক ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, লোককথা, মিথ, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুতেই ভালো-মন্দের এই দ্বৈতসত্ত্বার প্রভাব বর্তমান। পারসিক ধর্মতত্ত্ব খুবই প্রভাবশালী চিন্তাধারা হিসেবে বিভিন্ন ধর্মে অঙ্গীভূত হয়েছে। এই ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় যেমন- মসীহবাদ, বেহেশত-দোযখ, মৃত্যুর পরের বিচার, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ইত্যাদি বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টিয়ান, ইসলামসহ বিভিন্নধর্মে ছড়িয়ে গেছে। বর্তমানে এই ধর্মের অনুসারী তেমন নেই বললেই চলে। সবমিলিয়ে ১-১.৫ লক্ষ অনুসারী এখনো এই ধর্মটিকে জীবিত রেখেছেন। যার মধ্যে ভারতে প্রায় ৬০ হাজার, ইরানে ১৫ হাজার, আমেরিকায় ১৫ হাজার। অনুসারী না থাকলেও এই ধর্মের আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস।
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৬০০-৬৫০ থেকে শুরু করে ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পারসিক ছিলো ইরানের রাজধর্ম। এছাড়া চীন থেকে শুরু করে ইতালি (রোমান সাম্রাজ্য) পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিলো এই ধর্মের অনুসারীরা। মুসলিমদের হাতে ইরানের (তখনকার পারস্য) পতন হলে পারসিক ধর্ম রাজধর্ম হিসেবে তার গুরুত্ব হারায়। ইরান থেকে কিছু অনুসারী নৌপথে ভারতে চলে আসেন, বাকীরা ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত হন। ইরানের সংস্কৃতিতে এখনো পারসিকদের অবদান চোখে পরবে।
প্রাচীন বৈদিক ধর্মের সাথে এই ধর্মে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ধারণা করা হয় আর্যরা ভারতে প্রবেশের আগে দুইভাগ হয়ে একভাগ ভারতে প্রবেশ করে, অপরভাগ ইরানে প্রবেশ করে। আরেকদল গবেষকের মতে আর্যরা ইরান হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। যাই হোক না কেন, ভারতের মতো ইরানও প্রাচীন আর্যদের সংস্কৃতির ধারক-বাহক। আর্যদের সম্পর্কে জানতে হলে পারসিক ধর্ম সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়।
ইরান শব্দটি আর্য শব্দটিরই একটি অপভ্রংশ। আর্যকে ইংরেজিতে লেখা হয় Arya, আর যারা আর্য তাদের বলা হয় Aryan. Aryan এর পহ্লবী (মধ্যযুগের পারসিয় ভাষা) উচ্চারণ- Airyan. অর্থাৎ Aryan>Airyan>Iran. ইরান শব্দের মানেই আর্য।

শুভ ও মঙ্গলের ঈশ্বর, মহাজগতের সৃষ্টিকর্তা- আহুর মাজদা

পারসিক উপকথা অনুসারে জরথুস্ত্র নামে একজন নবী বা ধর্মপ্রচারকারী এই ধর্মের প্রচার করেন। উপকথা অনুসারে জরথুস্ত্রের জন্ম-মৃত্যু ধরা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১,৫০০ থেকে খিস্টপূর্ব ১,০০০ সালের মধ্যে। প্রাচীন ইরানের মেডিয়া সাম্রাজ্যের ইরানবেগকে জরথুস্ত্রের জন্মশহর মনে করা হয়। কারো কারো মতে বর্তমান আফগানিস্তানের বালখ শহরে তার জন্ম। গ্রীক ঐতিহাসিকরা তার নামের উচ্চারণ করতো জোরোস্টার, সেই থেকে বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় তাকে জোরোস্টার ডাকা হয়, তার অনুসারীদের ডাকা হয় জোরোস্টারবাদী। আধুনিক ও মধ্যযুগের পার্সি ভাষায় তাকে ডাকা হয়- ‘জারদুশ্ত’।
জরথুস্ত্র নতুন কিছু আইনকানুন প্রবর্তন করেছিলেন। তবে তার আগে থেকে প্রচলিত প্রাচীন আর্য রীতিনীতি এবং প্রাচীন ইরানের তৎকালীন ধর্মের সাথে সংমিশ্রণ করেই সেই আইন প্রচলন করেন বলে অনেকে ধারণা করেন। পারসিক ধর্ম আসার আগে ইরানে প্রচলিত ছিলো জুরভানবাদ, মিথ্রাবাদ এবং বৈদিক লোকায়ত ধর্ম। জরথুস্ত্র মানুষের কল্যানে নিয়ে আসেন গ্রন্থ- ‘জেন্দ আবেস্তা’।
জুরভান মানে সময়। জুরভানবাদীরা ঈশ্বরের অসীমত্বে বিশ্বাস করতো। ভালো-মন্দের দ্বৈতবাদ তাদের মধ্যে তেমনভাবে আসেনি। কোনো কোনো আহুর মাজদা এবং আহরিমান উভয়ের পিতাই হলো জুরভান। অসীম সময়ের সত্ত্বা জুরভান থেকেই ভালো এবং মন্দের উৎপত্তি। এরপরের পৃথিবী ভালো আর মন্দের দ্বন্দ্ব। এরপরে পৃথিবীর ইতিহাস ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বের ইতিহাস, সময়ের শেষ পর্যন্ত এই লড়াই চলবে। একদম শেষ সময়ে মন্দের উপর ভালো বিজয়ী হবে। আহুর মাজদা তার সৃষ্ট সকল ‘শুভ এবং মঙ্গলকে’ সাথে নিয়ে বেহেশতে অবস্থান করবেন।

অসীম সময়ের সত্ত্বা- দেবতা জুরভান

মিথ্রাবাদীরা সূর্যদেবী মিথ্রার উপাসক। ইরানী দেবী মিথ্রাকে অনেকে বৈদিক দেবতা মিত্র বা মিত্রা বলে মনে করেন। মিথ্রা পরবর্তীতে আহুর মাজদার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হয়ে উঠেন। পারসিক ধর্মে মিথ্রার অবস্থান অত্যন্ত উচ্চে। এমনকি মিথ্রাবাদ পরবর্তী সময়ে আলাদা ধর্মমত হিসেবে ইউরোপ-আফ্রিকায় ছড়িয়ে পরে। রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টিয়ান ধর্ম রাজধর্ম হওয়ার সময় তার অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো এই মিথ্রাবাদ। মিথ্রাবাদের প্রভাব খ্রিস্টিয়ান ধর্মের উপর প্রবল, সাম্প্রতিক ধর্মতাত্ত্বিক গবেষণাগুলোতে এসব বিষয় উঠে আসছে।

মিথ্রার ভারতীয় সংস্করণ মিত্রা

পারসিক এবং হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি এবং বৈদিক লোকায়ত ধর্ম নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা যায় না তবে দুই ধর্মের সাধারণ বিষয়গুলো যে বৈদিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার সেকথা বলাই বাহুল্য। পারসিক ধর্মের হাত ধরে বৈদিক চিন্তাভাবনা প্রসারিত হয় সেমেটিক ধর্মমতগুলোর দিকে।
ধর্মের ইতিহাসে অতিগুরুত্বপূর্ণ ছয়টি ধর্ম- ইসলাম, খ্রিস্টিয়ান, ইহুদি, বৌদ্ধ, পারসিক ও হিন্দু, এদের আলাপই ঘুরেফিরে আসবে। এছাড়া আলাপ চলাকালে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ধর্ম ও চিন্তা-মত-পথ আসতে পারে। কমপ্যারাটিভ রিলেজিওনের এই আলাপে পাঠককে স্বাগতম।

No comments:

Post a Comment